Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

নিমতলী থেকে বেইলি রোড : আর কত?

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিমতলী থেকে বেইলি রোড : আর কত?

প্রায় তিন বছর আগে, ২০২১ সালের ২৯ জুন যুগান্তরে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা কেন তলানিতে’। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) পরিচালিত জরিপের ফলাফল নিয়ে কলামটি লেখা হয়। জরিপটি ছিল পৃথিবীর ১৪০টি শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে। জরিপে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরের অবস্থান ১৩৭ নম্বরে। একে তলানি ছাড়া আর কী বলা যায়?

বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে ঢাকার তলানিতে অবস্থান সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তখন দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ করা হয়েছিল, গবেষণা সংস্থা ইআইইউ শহরের সাতটি বিষয়ের ওপর জরিপ চালিয়ে মান নির্ণয়ের পয়েন্ট দেয়। বিষয়গুলো হচ্ছে-সংস্কৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মান। সন্দেহের অবকাশ নেই-ঢাকা শহর সবকটি বিষয়েই অনেক কম পয়েন্ট পেয়ে তলানিতে অবস্থান করছিল। বিশেষ করে পরিবেশ ও অবকাঠামোতে ঢাকা শহর মানদণ্ডের নিুপ্রান্তে। কাজেই বহু বছর ধরেই বাসযোগ্যতার জরিপে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকার অবস্থান ১৪০টি নগরীর মধ্যে শেষ দশে, অর্থাৎ তলানিতে। উন্নতির লক্ষণ নেই।

ঢাকা শহর কতটা বাসযোগ্য

ঢাকা মহানগরীর অবকাঠামোর উন্নয়ন যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে হচ্ছে, তাতে বাসযোগ্যতা বলে কিছু আছে কি? গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের অগ্নিকাণ্ড ও বিপুল প্রাণহানির জন্য বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ সবাই ভবনের অবকাঠামোকেই দায়ী করছেন। আটতলা ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি। এটির নিচতলা থেকে উপরতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া সব ফ্লোরেই ছিল রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকান। এসব রেস্তোরাঁ-দোকানে রান্নাঘর ছিল, যেখানে গ্যাস ব্যবহার করে আগুন জ্বালানো হয়েছে এতদিন। যেখানে আগুন ব্যবহার হয়, সেখানে অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ভবনের কোথাও আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে বলা হয়েছে। অথচ এ ধরনের ভবনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।

তদুপরি, বিপদের সময় উপর থেকে নেমে আসার জন্য কোনো আলাদা সিঁড়ি বা ফায়ার এক্সিট ছিল না। একটিমাত্র সিঁড়ি, তাও আবার গ্যাস সিলিন্ডার, বস্তা প্রভৃতি রাখায় চলাচলের অনুপযোগী ছিল। যে কজন সিঁড়ি দিয়ে কোনোভাবে নেমেছিলেন, তারাও বের হওয়ার পথ বন্ধ দেখে আবার উপরে উঠে গেছেন। আগুনে ভবনটি পুড়ছে, ভেতরে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই, ভবন থেকে নেমে আসার বিকল্প সিঁড়িও নেই, এমনি পরিস্থিতিতে ভেতরে আটকে থাকা মানুষ তো মরবেই। ৪৬ জন মানুষ পুড়ে মারা গেলেন অসহায়ভাবে।

রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ক্রেনের সাহায্যে ভবনের উপরতলা ও ছাদে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের তারা নামিয়ে আনতে থাকেন। প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেল ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে। সে সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সবাই এবং টিভি দর্শকরা লক্ষ করেন-ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনগুলো ভবনের সামনের দিকে অজস্র বিদ্যুতের তারের জন্য ওপরের দিকে দ্রুত যেতে পারছে না। বিদ্যুতের তার মাটির নিচ দিয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু বেইলি রোডের মতো জায়গায় তা হয়নি। এ কারণেও উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত ও বিলম্বিত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত পৌনে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিভলেও ভবনের ভেতরে সর্বত্র ধোঁয়ায় ভরে ছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধোঁয়ায় অচেতন বহু মানুষকে ভবন থেকে বের করে আনেন। তাদের হাসপাতালে পাঠালে দেখা যায়, অনেকেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। বেইলি রোডের ঘটনার পরপরই পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি হয়েছে, ভালো কথা। কিন্তু কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ জনগণ জানতে পারে না। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করা হয়, তা বাস্তবায়িত হয় বলে মনে হয় না। যদি হতো, তাহলে অগ্নিকাণ্ড কমত; প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতিও যথেষ্ট কমে যেত।

অগ্নিকাণ্ড চলছেই

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড ঢাকা শহরের প্রথম বড় অগ্নিদুর্ঘটনা নয়। এর আগেও বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এ রাজধানী শহরে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামের আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। মৃত্যু হয় ১২৪ জনের। সে সময় আবাসিক ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু তা হয়নি। পুরান ঢাকার চকবাজারে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে আবার আগুন লাগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এতে প্রাণ হারান ৭১ জন। সেই বছরের মার্চে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন মারা যান। বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা সবার মনে আছে। সেখানে প্রাণহানি না ঘটলেও সম্পদের ক্ষতি ছিল বিপুল। ঢাকা শহরের কাছেই একটি খাদ্য কারখানার আগুনে পুড়ে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মারা যায়। গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। এ ঘটনার জন্য কারখানার মালিকসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও বিচার এখনো হয়নি। আরও অনেক ছোট-বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে এ শহরে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড থামছেই না। এ কারণে অনেকেই ঢাকা শহরকে মৃত্যুকূপ বলতে শুরু করেছেন।

ভবন নির্মাণে অনিয়ম

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের অগ্নিকাণ্ডের পর জানা গেল, এ ভবনের নির্মাণে অনেক অনিয়ম রয়েছে। আবাসিক-কাম-বাণিজ্যিক ভবন হলেও এতে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এ ভবনের প্রতি তলায় অনুমোদনহীন আটটি রেস্তোরাঁ চুটিয়ে ব্যবসা করেছে এতদিন। গ্যাসের সিলিন্ডারে ভর্তি ছিল প্রতিটি তলা ও সিঁড়ি। আগুনে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হওয়ায় অগ্নিকাণ্ড এত ভয়াবহ হয়েছে।

সবাই এখন বলছেন, ভবন নির্মাণ ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যথেষ্ট তদারকি ছিল না। কথাটি সত্য, কোনো সন্দেহ নেই। রাজউকের দায়িত্ব শুধু ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া নয়, ভবনটি ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা দেখাও। বেইলি রোডের মতো ব্যস্ত এলাকায় আটতলা গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে যে মাত্র একটি সিঁড়ি, বিপদের সময় বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই, এটি রাজউক দেখেনি। এটি রাজউকের অপরাধ। ভবনটিতে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা ছিল না, এটিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারকি করেনি। কেন করেনি, সেটাও জানতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে।

রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা চাই

ঢাকা শহরে হাজার হাজার রেস্তোরাঁ ও খাবার দোকান রয়েছে। লাখ লাখ নগরবাসী এসব খাবার দোকানে যান প্রতিদিন। বহু রেস্তোরাঁ, বিশেষ করে অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলো, বহুতল ভবনের উপরের দিকে। এসব রেস্তোরাঁ ভোক্তাদের জন্য কতটা নিরাপদ, সেটি বিবেচনা করা দরকার। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ প্রতিটি রেস্তোরাঁ ও বিপণিবিতান পর্যবেক্ষণ করে বলতে পারবে সেটি অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা থেকে নিরাপদ কি না। যদি নিরাপদ মনে করে, তাহলে রেস্তোরাঁর প্রবেশপথেই স্টিকার লাগিয়ে দিতে পারে, যাতে ভোক্তারা নির্ভয়ে সেখানে ঢুকতে পারেন। যদি নিরাপদ না হয়, সেটিও স্টিকার দিয়ে জানিয়ে দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা নেওয়া হলে রেস্তোরাঁ মালিকরা সাবধান হবেন, ভোক্তারাও তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। এটি একটি পরামর্শ মাত্র, তবে একেবারে মনগড়া নয়। এমন ব্যবস্থা সিঙ্গাপুরসহ অনেক উন্নত শহরে রয়েছে।

মোদ্দা কথা, বেইলি রোডের মতো অগ্নিকাণ্ড বা অগ্নিদুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে কঠোর তদারকি চালাতে হবে। ঢাকাসহ সব মহানগরীতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিতে হবে, তারা যেন অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যথাযথ তদারকি করেন।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম