Logo
Logo
×

বাতায়ন

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অর্থনীতি সামাল দেওয়া যাবে না

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অর্থনীতি সামাল দেওয়া যাবে না

‘দ্বিগুণ হয়েছে সন্দেহজনক লেনদেন।’ এটি গত ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম। এর অর্থ এতদিন ধরে সন্দেহজনক লেনদেন একটি চলমান বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এর ওপর কর্তৃপক্ষের নজরদারি ছিল-আছে, এজন্য যে সেটা যেন আর বেড়ে না গিয়ে কমে যায় ও একসময় বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তা কমেনি বরং উলটোপথে বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ হয়ে পড়েছে।

বড় বড় অপরাধীদের দেশ থেকে পালানো ও পালাতে দেওয়া আমাদের দেশে ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালিটি’র একটি বিশেষ রোগ। এটি বহু আগে থেকেই মাফিয়াদের টিকিয়ে রাখার ও টিকে থাকার কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সারা বিশ্বে। আমাদের দেশে সিঁদেল ও ছিঁচকে চোর বেশি থাকায় আগে এটার কথা তেমন একটা জনসম্মুখে ফলাও করে প্রচার করা হতো না। তবে মাদকদ্রব্য-চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুটের জন্য আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যেদিন থেকে গুরুত্ব পায়, তখন থেকেই বড় অপরাধীদের দেশ থেকে পালানো কিংবা পালাতে দেওয়া ব্যাধির ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।

যারা পালায় তারা রথী-মহারথী। আর যারা পালানোর সুযোগ করে দেয়, তারা আরও বনেদি, বড় দায়িত্বপ্রাপ্ত রথী-মহারথী। সম্প্রতি মাদকসম্রাটদের পলায়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের পবিত্র নগরীসহ পৃথিবীর অন্যত্র লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়, এসব অজানাও নয়। তবে আর্থিক ক্ষেত্রে মেগা কারবার শুরু হওয়ার পর থেকে এনালগ ও ডিজিটাল- উভয় কৌশলে সিদ্ধ অসামান্য অপরাধীরা নতুন করে আবির্ভূত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোচরে কোনো বড় লেনদেনের অসঙ্গতি এলে সেগুলোর সমাধানে তারা বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য নিয়ে থাকেন। সেসব বিষয়ে নজরদারির মাধ্যমে বড় বড় অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচারের মুখোমুখি করার জন্য বিশেষ কিছু সংস্থা একত্রে কাজ করছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের কাজকে সমন্বয় করে বার্ষিক রিপোর্টি প্রদান করে থাকে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেন দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার প্রতিবেদনটি দেশের আর্থিক খাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিসহ দুরাবস্থার চিত্রই তুলে ধরেছে; যা দেশের জন্য খুবই ভয়াবহ।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিএফআইইউয়ে পাঠানো প্রাথমিক তথ্য বা ডিজিটাল সংকেতগুলোর সূত্র ধরে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলো খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের সক্রিয় হওয়ার মূল কারণ সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা ও পরিমাণ ভয়ানক রকমের বৃদ্ধি। ২০২১-২০২২ সালে যে প্রবণতার সংখ্যা ছিল ৮,৭৫১টি, ২০২২-২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪,৮০৬-তে। এসব সন্দেহজনক লেনদেন ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে সম্পন্ন করা হচ্ছে।

এসবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ অভিযোগের উল্লম্ফন ৬৪.৫৮ ভাগ বলে প্রকাশ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ‘খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’ অথবা ‘এসবের তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত খুঁজে বের করা হবে’ বলে দায়িত্ব শেষ করতেন। সেটার সমাধান আদৌ হয়েছে কিনা তা পরবর্তীতে কেউ জানতে পারত না। অভিযুক্ত কারও গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, একটু আঁচড় দিলেও যেহেতু বিপদ হতে পারে, তাই তদন্তকারীরা কিছুদূর এগিয়ে থমকে যেতেন।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে একজন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিদেশে ২৬০টি বাড়ির মালিক হওয়ার তথ্য বারবার উঠে এসেছে। পিকে হালদার প্রমুখের কথাও আলোচনায় এসেছে। এসব বড় বড় সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের ঘটনা আলোচনায় আসা কোনো নতুন ঘটনা নয়। শুধু শুধু এসব সমস্যাকে আলোচনায় এনে একটু কচলানো হয়। দ্রুত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। এর ফলে বরং সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের ফাঁকফোকর খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। এ বায়বীয় ও ডিজিটাল যুগে ‘হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পাতা’ মানুষের সংখ্যা অগণিত। সবাই লাভের অঙ্ক কষে নিজ নিজ ফাঁদ পাতার কাজটি কৌশলে সেরে নিতে উন্মুখ হয়ে আছেন।

এদিকে রাজধানীতে চাকরি করা সাবেক সৎ ও নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মচারীদের কেউ কেউ চাকরি শেষ নিজ গ্রামে পাতার ছাউনির ডেরায় ফিরে জীবনের যবনিকা টানেন। তারা কোনো ধরনের অন্যায়ের সঙ্গে কোনো দিন আপস করেননি। দেশের সেবা করে গেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। আবার এ রাজধানীতেই চাকরি করা কিছু সাবেক অসৎ সরকারি কর্মচারী আছেন, যারা বসবাস করছেন তাদের নামে-বেনামে থাকা অগণিত ফ্ল্যাটবাড়িতে। তাদের সম্পদের হিসাব কেউ নেয় না। কারণ, দিনে দিনে তারা পালানো ও পালাতে দেওয়া অথবা কিছু গোছানো ও গুছিয়ে নেওয়াদের অন্তর্ভুক্ত থেকে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। তারাও সামান্য চোর নন। ২০২৪ সালে এসে ‘সেকি সামান্য চোরা’-যাকে কঞ্চির বেত মেরে সোজা করার উপায় খুঁজতে হবে? এমন নাজুক আর্থিক অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেলে, সে পরিস্থিতিতে আদৌ কেউ কাউকে পরোয়া করতে চায়?

ঠিক একই ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছে নিত্যখাদ্য পণ্যের বাজারে। দ্রব্যমূল্য-সন্ত্রাস এখন মোটেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা সীমান্তের বাইরের চক্রের বেড়াজালে এক প্রকার নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। আমাদের দেশে পেঁয়াজ কিংবা কাঁচামরিচের দামের ওঠানামা নির্ভর করছে সীমান্তের বাইরের পর্যবেক্ষণের ওপর। একটি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা কীভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এখন এ দেশের মধ্য ও নিম্নআয়ের ভোক্তাগোষ্ঠী।

ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ নয়ছয় ও পাচারকারীরা বেপরোয়া। বাজার থেকে নিত্যপণ্যের মালামাল উধাওকারীরা ডলারের দাম বেশি বলে অগ্নিমূল্য হাঁকিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছেন। তারা নৈতিকতা হারিয়েছেন অন্যদের কার্যকলাপ দেখে। সেজন্য রমজানকে উপলক্ষ্য করে মাত্র এক মাসের জন্য খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর অনুরোধ করতে হচ্ছে খোদ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকেই! একটি স্বাধীন দেশে সেটা কেন হবে? বাকি ১১ মাস মানুষ বেশি দামে নিত্যপণ্য কেনার টাকা কোথায় পাবে? শুধু রমজানের দোহাই দেওয়াটা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না। আমাদের নিত্যপণ্যের বাজারেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে প্রবলভাবে একনায়কতন্ত্রের জেদি প্রভাব বিদ্যমান। তাদের একাই লাভ করব, একাই খাব মনোভাবের পরিবর্তে যতদিন গণতান্ত্রিক সহনশীল মনোভাব আসবে না, ততদিন দ্রব্যমূল্য কমাবেন কীভাবে? বাজারদর নিয়ন্ত্রণকারীরা যে বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এছাড়া কম দামে খাদ্যপণ্য কিনে শুধু রমজানে কেন মানুষ বেশি খাবে? রমজান মাস তো কৃচ্ছ্রসাধনের মাস। যারা আসল রোজাদার, তাদের বেশি খাদ্য ভক্ষণ করার কোনো জো নেই এ পবিত্র মাসে। প্রতি রাতে দেড়-দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তারাবি আদায় করতে হলে পেট ভরে খাবার উপায় নেই। অবশ্য যারা তারকা হোটেল থেকে ইফতার-সেহরি কেনেন, তারাবিতে যান না, তাদের কথা আলাদা।

অর্থনীতি-সামাজিক দুর্নীতির জন্য আমাদের দেশে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নানা সময়ে বহু নীতি-পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এজন্য অনেক রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। এসব পথনকশায় যারা ধরা পড়েছেন ও পড়ছেন, তাদের মধ্যে দলকানা রাজনৈতিক বিবেচনা কার্যকর হওয়ায় অনেক সাধু হয়ে গেছেন অসাধু। আবার অনেক অসাধু অতি সহজে পরিত্রাণ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে আবারও সামাজিক ভাঙনকে ত্বরান্বিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।

আর্থিক সন্দেহজনক লেনদেনই শুধু দ্বিগুণ হয়নি, ঢাকার জমি-বাড়ির দামও টোকিওর দ্বিগুণ। আমাদের অভিজাত নামধারী কোনো রেস্টুরেন্টে একগ্লাস জুস, একটি আলু বা চিকেন চপের দাম কেন ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বেশি হবে? তাদের দেশে মাথাপিছু আয় গড়ে ত্রিশ হাজার থেকে ঊনচল্লিশ হাজার ডলার, আমাদের কত? আমরা তো তাদের তুলনায় মাথাপিছু সিকিভাগও আয় করি না। অথচ আমাদের অসামান্য চোররা এ আর্থিক বৈষম্য ও প্রবঞ্চনা তৈরি করে দিয়েছে; যার ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের অগ্নিমূল্য জনমনে চরম হতাশার জন্ম দিয়েছে।

তাই, শুধু মুখের কথা দিয়ে পরিত্রাণের চিন্তা না করে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে চোরদের পালানো ও পালাতে দেওয়া হোতাদের দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের চার পাশের বাস্তবতায় ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝতে হবে। নিজ দলের মন্দদের জন্য দলকানা হয়ে উদার হব কেন? দলকানা একটি রোগ, এ রোগীরা দুর্নীতি করার জন্য দলবেঁধে দলান্ধ হয়। এদের দৌরাত্ম্য কখনোই কমে না। এ নীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। তা-না হলে সামান্য চোরদের অসামান্য হয়ে উঠতে দেরি হবে না। এসব বেপরোয়া চোরের সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ন্ত্রণে সর্বদলীয় শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম