ভবনের সুরক্ষা নিশ্চিতে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব বেশি
গওহার নঈম ওয়ারা
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ৪৬-এ দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন ১২ জন। তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। ঘটনা তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের কমিটির পাশাপাশি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক) ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফাইলপত্র পরীক্ষা করে এ কমিটি জানতে পেরেছে, ভবনের নির্মাণ অনুমোদন সঠিক আছে, নকশারও কোনো ত্রুটি নেই। তবে ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক হলেও উপরের দুই তলাও বাণিজ্যিক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা
আমরা যে কতটা অসহায়, বৃহস্পতিবারের ঘটনায় সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। কারণ দেখা যাবে, এ ঘটনায় বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছে সাফোকেশনে বা শ্বাসকষ্টের মতো কারণে। তাছাড়া এ ভবনটি তৈরিই হয়েছে পুরোটা কাচ দিয়ে। এখানে যদি কাচ দেওয়া না থাকত, তাহলে হয়তো এমন পরিস্থিতি হতো না, বাতাস চলাচল করতে পারত। এগুলো নিয়ে আমাদের অফিসিয়ালি ভাবতে হবে। এখন আমরা নানা কথা গণমাধ্যমে বলছি। সরকার তথা কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে, আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার আমরা বহন করব; কিন্তু ভবনের যারা মালিক, তারা কেন চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন না? কেন জনগণের অর্থ এখানে খরচ হবে? মানুষ ধরেই নেয় ক্ষতিপূরণের দায়িত্বটা সরকারের। কিন্তু আমাদের তথা সরকারের তো এটি পুরোপুরি দায়িত্ব নয়। সরকারের দায়িত্ব যেটুকু, সেটুকু তো আমরা ঠিকমতো পালন করতে পারিনি। দেখুন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটা ২৯ তারিখে হয়েছে এবং ওই ভবনে যারা ছিল, তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক। তাদের কারোই কিন্তু বেতন হয়নি। এ কথাটা কাউকে বলতে শুনেছেন? হ্যাঁ ঠিক আছে, যারা মারা গেছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; কিন্তু ওই মানুষগুলোর এখন দিন চলবে কীভাবে? এ বিষয়গুলো ভাবার মতো মানুষ আমাদের দেশে নেই। যে এটা ভাবতে পারছে না, সে এ আগুন কীভাবে নেভাবে? সবাই কোট-প্যান্ট পরে টেলিভিশনের সামনে এসে নানা কথা বলছেন : আমরা এটা করব, সেটা করব; কিন্তু কী কাজ করেছেন আপনারা? এর জবাবদিহি আপনাদের করতে হবে। সেটা তো হচ্ছে না।
শুধু বেইলি রোডেই নয়, সাত মসজিদ রোড কিংবা শহরের আরও অনেক এলাকায় গেলে দেখা যায়, বহুতল ভবনগুলোতে সব খাবারের দোকান তৈরি হচ্ছে। এসব জায়গা থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই, দরজাগুলো সবই ভেতরের দিক থেকে খোলে বা বাইরে থেকে খোলার কোনো দরজা নেই। এক্ষেত্রে মানুষ তো বেরই হতে পারবে না। আমাদের যেটা করা উচিত তা হচ্ছে, এগুলো আগে বন্ধ করা। ওগুলো এখন কে বন্ধ করবে? সেক্ষেত্রে আমাদের ওয়ার্ড কমিশনার অর্থাৎ স্থানীয় সরকারে যারা আছেন, তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব খাবারের দোকান তো তাদের চাঁদা দিয়েই চলে, তারা কীভাবে করবে? কিন্তু কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। এখন ওখানে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সেটা তো ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। তাকে জবাবদিহির আওতায়, আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই সংকট কিছুটা কাটবে।
বেইলি রোড তো আগে পুরোটাই আবাসিক এলাকা ছিল। সেটা কীভাবে রাতারাতি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হলো? কার পরামর্শে এটা হলো এবং বাণিজ্যিক এলাকায় পরিবর্তন হলে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল তা কেন নেওয়া হয়নি, সেসব তদন্ত করে দেখা দরকার। এর আগে ওই ভবনে আমিও গিয়েছিলাম। সিঁড়িগুলোর ভেতরে অনেক জিনিসপত্র রাখা রয়েছে। মানুষ যেহেতু লিফটে ওঠানামা করে, তাই সিঁড়িগুলো তাদের জিনিসপত্র রাখার, সিলিন্ডার রাখার জায়গায় পরিণত হয়েছে। এসব কে দেখবে? এসব বিষয় ওখানে যিনি ওয়ার্ড কমিশনার আছেন, আমার মনে হয় তাকেই দায়িত্বটা দেওয়া উচিত। এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাকেই প্রথমে ধরা উচিত। প্রশ্ন করতে হবে, তোমার এলাকায় এমনটি কেন হলো? এটার দায়-দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। তিনি যেহেতু কমিশনার হয়েছেন, তার এলাকার বিষয়গুলো তো তাকে জানতে হবে। আমার মনে হয়, স্থানীয় সরকারকে যদি আমরা শক্তিশালী করতে না পারি, তাদের যদি দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে না পারি, তাহলে এমন দুর্ঘটনা আরও ঘটবে। এমন দুর্ঘটনায় আমরা বাঁচাতে পারব না কাউকে।
আরেকটি বিষয়। অগ্নিকাণ্ডের খবরে বৃহস্পতিবার ঢাকার সব ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। তো এ সময় যদি অন্য কোনো জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত, তখন কী হতো? অবস্থাটা একবার ভাবুন। এসব বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। ওইভাবেই তাদের তৈরি করতে হবে। আমরা দাবি করছি, আমাদের এত হাজার আর্বান ভলান্টিয়ার আছে। কোথায় ছিল ভলান্টিয়ারগুলো? এসবই কি শুধু কাগজে-কলমে? এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং স্থানীয় সরকারকে ওয়ার্ডভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে হবে। আগে আমাদের ফায়ার সার্ভিসে একটা সিস্টেম ছিল-‘ওয়ার্ডেন সিস্টেম’, সেই ওয়ার্ডেন সিস্টেমে আবার আমাদের যেতে হবে। ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে যে আরেকটা নাম আছে, ‘ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স’, সেই সিভিল ডিফেন্সটাও আমাদের জোরদার করতে হবে। এবং সেখানে আমাদের উপযুক্ত লোকদের দিতে হবে।
এখন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেওয়ার কথা আমি বলতে পারি, তবে সেটা বলতে গেলে তো ফায়ার সার্ভিস বলবে, আমাদের লোকবল নেই। সেজন্যই এ দায়িত্বটা আমি মনে করি, স্থানীয় সরকারের হাতে দিতে হবে। এবং স্থানীয় সরকার প্রয়োজন হলে ফায়ার ব্রিগেডকে ডেকে নিয়ে আসবে। মিয়ানমারে কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডের এত অফিস নেই; কিন্তু ওদের ওখানে আগুন লাগে না। তারা একেবারে কমিউনিটিভিত্তিক মানে গ্রামকেও সুরক্ষার মধ্যে সংযুক্ত করেছে। তাদের দেশে গণতন্ত্র না থাকার মতো অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে; কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষার ব্যাপারটি তারা সামাজিক কর্তব্য-ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এসেছে। আমাদের এখানে তো এটা আরও করা সম্ভব। এদিকেও আমাদের যেতে হবে। এ ব্যাপারে শুধু ফায়ার ব্রিগেডকে একক দায়িত্ব দিলে চলবে না। কারণ, ফায়ার ব্রিগেডের চিরকালই লোকবলের অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতার কথা বলা হবে, নানা সমস্যা থাকবে; কিন্তু স্থানীয় সরকার যদি এসব সুরক্ষার বিষয়ে দায়িত্ব নেয়, তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। স্থানীয় সরকারের যারা কমিশনার আছেন, এটা কোট-আনকোট সবাই জানে যে, কাদের পয়সায় তারা চলে। তো তাদের তো একটু সাবধান হতে হবে-যাদের কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছো তোমরা, তারা যেন বাঁচে প্রাণে। আমি মনে করি, সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব হওয়া উচিত।
গওহার নঈম ওয়ারা : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ