বিচারাধীন মামলার জট নিরসন জরুরি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম-দর্শন ও পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের মূলে রয়েছে সামষ্টিক বিচারব্যবস্থার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। অপরাধীকে শাস্তি প্রদান শুধু অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করে না; অন্য কেউ যাতে এ ধরনের অপরাধে যুক্ত না হয়, সে শিক্ষা জনগণকে সতর্ক করে। ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ-বয়স, দলমত নির্বিশেষে আইনি কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রত্যেক নাগরিক তার প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শুধু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশকে নয়; পুরো বিশ্বকে কলুষিত করার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপাদান হিসাবে কাজ করে। স্বচ্ছ-স্বাধীন-নৈর্ব্যক্তিক বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা সভ্যতার সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরিগণিত। আদিম সমাজ থেকে শুরু করে দাসপ্রথা, সামন্তযুগ, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মোড়কে সমাজ পরিবর্তন এবং শিক্ষা, আইন, দর্শন, বিশ্বাস ইত্যাদির অনুশীলন কার্যকর থাকার প্রাসঙ্গিকতা দেশে দেশে যুগে যুগে বিদ্যমান।
বিভিন্ন মতানুসারে রাষ্ট্রের উৎপত্তির পেছনে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। বিচার বিভাগ যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। ব্যক্তি স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং সংবিধান সমুন্নত রাখতে বিচার বিভাগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং এর বিকাশ আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি। সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং জনপ্রিয়তার উত্থান-পতন নির্ভর করে বিচার বিভাগের সত্যনিষ্ঠ কর্মক্ষমতা ও কার্যদক্ষতার ওপর। বিচার বিভাগের উৎকর্ষতা-পরিপূর্ণতা, প্রকৃতির উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনে এর স্বাধীন সত্তাকে সুরক্ষা দেওয়া ন্যায়সংগত। পক্ষান্তরে বিচারকদের দায়িত্ব হচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন বিচার বিভাগের মৌলিক কাজ। এক্ষেত্রে বিচারকরা দোষী ব্যক্তির শাস্তিবিধান করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কোনোক্রমেই যেন নির্দোষ ব্যক্তি শাস্তি না পায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। বাস্তব ঘটনাবলী সংক্রান্ত তথ্য-নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও এর পর্যাপ্ত মূল্যায়নে যে কোনো মামলাতেই বিচারকরা এ কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করেন, যাতে অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা ও দণ্ড প্রদান সহজ হয়।
এটি সর্বজনবিদিত যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সমাজের মৌলিক ভিত্তি রচনা করে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদির সব স্তরের নানামুখী বিরোধ, বিচ্ছেদ, অরাজকতা, সহিংসতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বৈষয়িক-পারিবারিক সমস্যা সমাধানে আইনের যথাযথ প্রয়োগ সমাজের স্বাভাবিক চলমানতার প্রধান রক্ষাকবচ। বিবর্তন-পরিবর্তনমুখী জীবনপ্রবাহে বিভিন্ন জটিলতা এমনভাবে প্রতিনিয়ত অমানবিকতা, অনৈতিকতা ও নিপীড়ন-নির্যাতনের দৃশ্যপট তৈরি করছে, যা আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। লুম্পেন-বুর্জোয়া ব্যবস্থার জাঁতাকলে সমাজের পঙ্গুত্ব এমন এক অসহায় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; যেখানে সৌহার্দ-সম্প্রীতির মানসিকতা মোটেই দৃশ্যমান নয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান্য বিষয়েও ক্রোধ-ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, নরপশুতুল্য আচরণ লক্ষ করা যায়। আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগলেও এবং ব্যাপক অর্থ ব্যয় হলেও মানুষ আইনের আশ্রয় গ্রহণকে প্রণিধানযোগ্য মনে করছে। বিভাজিত সমাজে অর্থ, ক্ষমতা, আধিপত্য, দৌরাত্ম্য, অশুভ লবিং, তদবির, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন নিরীহ-গরিব মানুষদের অধিকতর পর্যুদস্ত করে চলেছে।
সামান্য জমিজমা-ধনসম্পদ রক্ষায় তারা কথিত প্রভাবশালীদের সঙ্গে কোনোভাবেই টিকে থাকার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। গ্রাম-শহর-তৃণমূল পর্যায়েও জনপ্রতিনিধি, মোড়ল-সর্দার-মাতবর, বড়ভাই-গডফাদারদের কদর্য আচরণে এদের আর্তনাদ ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অবস্থায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়া মুক্তির যৌক্তিক উপায় হিসাবে প্রতীয়মান। কতিপয় অসাধু ব্যক্তি, আইনজীবী ও দালালচক্রের আর্থিক কষাঘাতে নিদারুণ যন্ত্রণায় সম্পদহীন হওয়া ছাড়াও অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আধুনিক সমাজে আদালতের শরণাপন্ন হয়েও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ থেকে কোনো অর্থবহ সুফল লাভে অনেকে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অসহায়ত্ব সমাজকে কোনদিকে ধাবিত করছে, তা মনে হয় সমাজপতি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের মোটেও বিচলিত করছে না। আদালতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বিচারাধীন মামলা, মামলাজট নিয়ে জনমনে যে অসন্তোষ বিরাজ করছে, তা বিভিন্ন পর্যালোচনায় অতি স্পষ্ট।
২৩ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিমকোর্ট সূত্রের বরাতে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ বিচারিক আদালতে মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পাশাপাশি মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। মামলার চেয়ে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকাংশে কম হওয়ায় প্রতিদিন নতুন করে মামলাজটে যুক্ত হচ্ছে সিংহভাগ মামলা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, বিচারকের স্বল্পতা, সাক্ষীদের গরহাজির, বারবার সময় প্রার্থনা এবং কিছু আইনজীবীর ভূমিকার কারণে দেশে উচ্চ ও নিু আদালতে প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া জনস্বার্থ রক্ষায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে করা মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে আদালত অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে এবং ইতোমধ্যে আদালতের স্বপ্রণোদিত এখতিয়ার জনস্বার্থমূলক মামলার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ৮৬ হাজার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ আইন কমিশনের প্রতিবেদন মতে, উচ্চ আদালতসহ দেশের সব আদালতে বিগত ১৫ বছরে প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও বিচারাধীন হিসাবে ঝুলে আছে ৪০ লাখের বেশি মামলা। সময়ের ব্যবধানে দেশে মামলাজট সংখ্যায় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
বিজ্ঞ আইনজীবীরা এ সংখ্যাকে তুলনামূলক কম বলে মন্তব্য করেন। তাদের মতে, ‘দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি দুই পক্ষের সম্মতিতে সহজ; কিন্তু ফৌজদারি মামলা তত সহজ নয়। স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ দায়িত্বে তাদের কাজগুলো সারলে আদালতের ওপর চাপ কমবে, তেমনি জনগণও ওইসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে পারবে। তা না হলে জনগণ আদালতমুখী হয়ে পড়বে। ফলে আদালতের নির্দিষ্ট মামলাগুলোর শুনানিতে মারাত্মক ক্ষতি হবে। মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি অনুসরণ করলেই সুফল পাওয়া যাবে। উভয়পক্ষকে যদি বোঝানো যায়, মামলা করলে ১০ বছর ক্ষতি হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে এগিয়ে এলে দুই পক্ষই লাভবান হবেন। তাই দেশের আদালতগুলোর মামলাজট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর জোর দিতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে মাননীয় আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আগের তুলনায় মামলাজট কমতে শুরু করেছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে মামলাজট অনেকাংশে কমে যাবে। মানুষ মরে যায়, অথচ দেওয়ানি মামলা চলে কয়েক পুরুষ ধরে। এ ব্যবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। বিচারপ্রার্থীরা বিচারের আশায় লাখ লাখ টাকা খরচ করে, কিন্তু তারপরও কাঙ্ক্ষিত বিচার তারা পায় না। দিনের পর দিন সময় প্রার্থনার নামে সুপরিকল্পিতভাবে ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা হয়।’
মামলাজট কমিয়ে আনা বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণকে সুদৃঢ় ও টেকসই করার লক্ষ্যে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন ও বিচার বিভাগ সারা দেশে ফৌজদারি মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে বিচারকাজ ত্বরান্বিত করার জন্য বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও এজলাস সংকট নিরসনে নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিচারকাজে গতিশীলতা বাড়াতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারকের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সারা দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘সাউথ এশিয়ান কনস্টিটিউশনাল কোর্টস ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি : লেসন ফ্রম বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৬ সালের আগে ক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টেই বন্দি ছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসি এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করি। কিন্তু উচ্চ আদালতের ক্ষমতা আবার ২০০১ সালে বিএনপি কেড়ে নেয়। এরপর ২০০৯ সালে আমরা নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম, দেশের মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করব। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এদেশ থেকে চিরতরে দূর করব। আমরা সেই কথা রাখতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ক্ষমতা দেশের মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এখন মানুষ দ্রুত বিচার পাচ্ছে। ডিজিটাল থেকে বিচার বিভাগকে সরকার স্মার্ট করার চেষ্টা করছে। আমি চাই, আমার দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পায় এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত হয়।’
বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, জনসাধারণের বদ্ধমূল ধারণা, দেশে দরিদ্রদের জন্য সুবিচার এখনো কল্পনাতীত। এ পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধানের বক্তব্য যেন বাস্তবায়ন হয় এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কোনোভাবেই বাধা হয়ে না দাঁড়ায়-জনগণের এ প্রত্যাশা সর্বক্ষেত্রে পূরণ হোক।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়