Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

উদ্যোগটি সফল হোক

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উদ্যোগটি সফল হোক

২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে একজন সংসদ-সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের আইন সংসদে তোলা হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। গত বছর জানুয়ারিতে একজন সংসদ-সদস্য উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবি জানালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, ‘উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার কাজ চলছে। কিছুদিনের মধ্যে এ আইন জাতীয় সংসদে তোলা হবে।’ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়ন কেন জরুরি, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত সুপ্রিমকোর্টে (সাধারণত উচ্চ আদালত নামে অভিহিত) বিচারক নিয়োগে যে নতুন শর্তটি সংযোজন করা হয় সেটি হলো, আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে কোনো ব্যক্তি সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর এক যুগ পার হলেও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে যোগ্যতা নির্ধারণ করে কোনো আইন প্রণীত হয়নি। তবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার আগে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭ ও ২০০৮) উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ জারি করেন। এতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নয় সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে দুজন প্রবীণতম বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত দুজন সংসদ-সদস্য, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং আইন সচিবকে এ কমিশনের সদস্য করা হয়। আপিল বিভাগে বিচারক পদে এবং হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে নাম সুপারিশ করার জন্য এ কমিশনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

সুপ্রিমকোর্টের জনৈক অ্যাডভোকেট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করন। ২০০৮ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট ব্যাখ্যা চেয়ে সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। রিট পিটিশনটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। ওই সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ অনুমোদনের জন্য সংসদে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। ফলে অর্ডিন্যান্সটি কার্যকারিতা হারায়।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণে বিরত থাকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, আইনজ্ঞ ও আইনজীবী সমিতির প্রস্তাবের প্রতি কোনো গুরুত্বারোপ করা হয়নি। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি নীতিমালা করার পক্ষে মত দেন।

২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে। আবেদনকারী ব্যক্তিকে সম্পদের বিবরণ উল্লেখসহ সুপ্রিমকোর্টে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। এটি বিচারক নিয়োগকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকর কমিটির সাধারণ সভায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন না থাকায় বিচারক নিয়োগের বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ করার অভিযোগ ওঠে। উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের সব পর্যায়ে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে বিচারক হিসাবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি অনধিক দুই বছরের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত কোনো অতিরিক্ত বিচারককে দুই বছর বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী না করা হলে তিনি ওই পদে বহাল থাকেন না। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগকে দলীয়করণ হিসাবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কোন বিবেচনায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয় তা জানাতে এসসিবিএ তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে নোটিশ প্রদানের এবং মন্ত্রীর জবাব সন্তোষজনক না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয়।

আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। এসসিবিএ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এ দুজনের শপথবাক্য পাঠ করান। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরেও বিচারক নিয়োগে দলীয়করণের।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শেখ হাসিনার শাসনের তৃতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) পদত্যাগে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক মো. আবদুল ওয়াহাব মিয়া প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগে তার জুনিয়র বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কর্তৃক অতিক্রান্ত হন। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে জ্যেষ্ঠতা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিচারক মো. মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। এরও আগে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে বিচারক এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, সে আমলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক মো. রুহুল আমিন ও বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে যথাক্রমে বিচারক কেএম হাসান ও বিচারক সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়।

উচ্চ আদালতে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়েও রাজনীতি করার অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়-প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার দুই বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধানটুকু বিলোপ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম এক আদেশের (Second Proclamation Order No. IV of 1976) মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান পুনর্বহাল করা হয়। সায়েম পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক আদেশে (Second Proclamation Order No.I of 1977) ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল, সেটিকে ঠিক ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান রহিত করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, সংবিধান নির্দেশিত আইনটি প্রণয়ন করা হলে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছামতো উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, বিশেষ করে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ বহুলাংশে হ্রাস পাবে। তাই বিচার বিভাগ ও জনগণের স্বার্থে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের আইনটি যত তাড়াতাড়ি প্রণীত হয়, ততই মঙ্গল।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম