Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

মা-বাবাকে ভালোবাসুন নিঃস্বার্থভাবে

Icon

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মা-বাবাকে ভালোবাসুন নিঃস্বার্থভাবে

হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা আল কাবুতের ৮নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।’ হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরিয়সী।’ খ্রিষ্টধর্মেও একইভাবে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বর জগতের পিতা। পিতারূপী ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান।’ বস্তুত সব ধর্মেই পিতা-মাতার মর্যাদার প্রতি গুরুত্বের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

আমাদের দেশে এখন যারা সত্তরোর্ধ্ব বাবা-মা আছেন, তারা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। এক জরিপে দেখা যায়, যেসব বৃদ্ধা মা বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৭০ বছরের উপরে এবং স্বামীহারা, তাদের সমস্যার অন্ত নেই। কারণ আমাদের বাবা-মা যখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তখন তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল কমপক্ষে ১৫-২০ বছর। বয়সের এ পার্থক্যের কারণে বাবারা সাধারণত মায়েদের তুলনায় অনেক আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমান। বিধবা করে রেখে যান তার বহুদিনের জীবন সঙ্গিনীকে। ফলে গভীর অন্ধকারে নিপতিত হন জীবনসঙ্গী হারানো মা। তখন সন্তানরাও নিজেদের সংসার ও সন্তানসন্ততি নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, তারা বৃদ্ধা অসহায় সম্বলহীন গর্ভধারিণীকে না দিতে চান সময়, না দিতে চান প্রয়োজনীয় সেবা। বরং এ নিঃস্বার্থ গর্ভধারিণী মাকে স্বার্থপরতার বেড়াজালে বন্দি করে তার সঙ্গে নির্মম আচরণ করতে দ্বিধা করে না অনেক সন্তান। আমাদের মানবতা তখন সব মানবিক সূচকে সর্বনিু স্তরে চলে যায়, আর হিংস্র পশুত্ব সব প্যারামিটারের ঊর্ধ্বে অবস্থান নেয়। আমরা হায়নার মতো পশুত্ব প্রদর্শনেই যেন নিজেদের নিয়োজিত করি। অথচ সব ধর্মেই এ হীন কাজকে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে পবিত্র কুরআনে সূরা বনি ইসরাইলের ২৩-২৫নং আয়াতে মহান আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো।’ ‘আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া করো যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশে লালন-পালন করেছিলেন।’ ‘তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের অন্তরে যা আছে তা ভালোভাবেই জানেন। যদি তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’ হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘পুত নামক নরক থেকে যে উদ্ধার করতে পারবে তার নামই পুত্র।’

আমরা যদি পুত্রের বর্তমান কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে পুত্র নামের তাৎপর্য কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা বুঝতে বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। একজন বাবা তার সন্তানকে শুধু পৃথিবীর বুকেই নিয়ে আসেননি, শরীর ও মনের সব ভালোবাসা ও হৃদয় নিংড়ানো দরদ দ্বারা সন্তানকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা দেওয়াই বাবার জীবনের একমাত্র মিশন ও ভিশন।

একইভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দটি হলো মা। যদি কারও সঙ্গে তার সব বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করে, মা কখনোই তার সেই সন্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা দূরের কথা, তার বিন্দুমাত্র অনিষ্ট হবে এমন কোনো চিন্তাও করতে পারেন না। একজন মায়ের সব চিন্তা, সব আরাধনা, সব তপস্যা সন্তানের মঙ্গলের জন্য। সন্তানের কিসে ভালো আর কিসে মন্দ, তা মায়ের চেয়ে কখনোই কেউ বেশি জানতে পারে না। সন্তান মাকে শত কষ্ট দিলেও ওই সন্তানের হাসির চেয়ে প্রিয় বস্তু পৃথিবীতে মার কাছে আর কিছুই নেই। প্রচণ্ড শীতের দিনে গরম কাপড়ের নিচে আরাম করে ঘুমানোর সময় যখন সন্তানসন্ততি প্রস্রাব-পায়খানা করে দেয়, তখন মমতাময়ী মা সবকিছু পরিষ্কার করে সন্তানকে আবার আরামের জায়গায় ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেন। নিজে চরম কষ্ট করে নিশ্চিত করেন সন্তানের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। সন্তানের নিরাপত্তায় মা তার সর্বোচ্চটুকু দিতে সামান্যতম কার্পণ্য করেন না। একজন মমতাময়ী মায়ের যদি ১০ জন সন্তানও থাকে, তাদের সবার মঙ্গল কামনায় এতটুকু হেরফের হয় না।

অথচ অনেকে তার মা-বাবাকে বৃদ্ধকালে অবজ্ঞা আর অবহেলা করে। সামান্য একটু অর্থ বা স্বার্থের জন্য এমন মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, যাদের সারাজীবনের আরাধ্য ছিল আমাদের মঙ্গল। যে বাবা নিজের ভালো-মন্দ চিন্তা না করে সন্তানের ভালো-মন্দের চিন্তায় সর্বক্ষণ তাড়িত হয়েছেন, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা কি সমীচীন? যখন সন্তানের মুখে কোনো ভাষা ছিল না, ছিল শুধু কান্না, তখন মা সন্তানের কান্নার প্রকৃত অর্থ বুঝে তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করেছেন। আজ সেই মা তার সামান্যতম চাহিদার কথা আমাদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও কেন আমরা তার প্রয়োজনীয়তা না শুনে উলটো তার ওপর নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ করছি? যে মায়ের মুখ থেকে শুনে মাতৃভাষা শিখলাম, বুঝলাম, চিনলাম, পরিচিত হলাম সব কিছুর সঙ্গে, আজ সেই মাকেই ভুলে গেলাম বেমালুম! যে মা আমার অসুস্থতায় বিনিদ্র রজনী উৎকণ্ঠা আর নিবিষ্ট সেবায় পার করছেন, আজ তার অসুস্থতায় আমি কীভাবে আরামের ঘুম ঘুমাতে পারি? নিজের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা থাকা সত্ত্বেও জনম দুঃখী মায়ের চিকিৎসায় একটা কানাকড়িও ব্যয় করি না। কোন অজানা পশুত্ব আমার মানবতাকে গ্রাস করল? একটিবারও কি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘পল্লী জননী’ কবিতার সেই লাইন মনে পড়ে না-

‘শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,

তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে, ... ... ...

পাণ্ডুর গালে চুমু খায় মাতা। সারা গায়ে দেয় হাত,

পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।’

এমন অনেক মমতাময়ী মা আজ বাস্তুহারা, অসহায়; চিকিৎসার অভাবে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আর তাদের সন্তানরা নিজের চাহিদা পূরণে নিমগ্ন। ভুলেই গেছে তাদেরও সন্তানসন্ততি রয়েছে। ভুলেই গেছে তাদেরও বয়স হয়েছে। তাদের ছায়াও নিজের দৈর্ঘ্যরে চেয়ে বড় হতে শুরু করেছে। তাই আসুন সূর্যাস্তের আগেই সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে মরীচিকার পেছন ছেড়ে বাস্তবতার দিকে ধাবিত হই। কাচ ফেলে হীরার যত্ন করে সত্যিকারের লাভবান হই।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগ প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম