Logo
Logo
×

বাতায়ন

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা দারিদ্র্য ও বেকারত্ব

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা দারিদ্র্য ও বেকারত্ব

চলতি বছরে বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব বাড়বে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং স্থবির উৎপাদনশীলতা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক ট্রেন্ড ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির অভিঘাত এখনো শ্রমবাজারে অনুভূত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তরুণদের বেকারত্বের হার চ্যালেঞ্জ হিসাবেই থেকে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই এমন মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক, বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের মধ্যে। তবে করোনা মহামারি-পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ২৯.২ থেকে বেড়ে ৪২.৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তারপরও নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার প্রাক-মহামারি পর্যায়ের নিচে নেমে গেছে। ২০২৪ সালে অতিরিক্ত ২০ লাখ মানুষ বাজারে কাজ খুঁজবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিগত ৫২ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে লক্ষণীয়ভাবে। এ সময়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের এ অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে প্রয়োজন সম্পদের সুষম বণ্টন ও মানবসম্পদের উন্নয়ন। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী ও শিশু মৃত্যহার হ্রাস পেয়েছে। ধারাবাহিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সমৃদ্ধির এ সুফল ভোগ করছে খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ২ জন কোটিপতি নিয়ে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ থেকে ১৮ কোটি এবং কোটিপতির সংখ্যা সরকারি হিসাবেই ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, শীর্ষ ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের হাতে রয়েছে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর দেশে ধনী-দরিদ্রের সম্পদের বৈষম্য যেখানে ছিল ২.৪ শতাংশ, সেখানে এখন তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালায়। দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমেছে ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে ২০.৫ শতাংশ ও শহরে ১৪.৭ শতাংশ। অতিদরিদ্র ৫.৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে এ হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ ও ২০১০ সালে ছিল ৩১.৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী আরও জানা যায়, দেশের প্রায় প্রতি পাঁচ জন মানুষের মধ্যে একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। মোট জনসংখ্যার ২১.৯১ শতাংশ মানুষ মাঝারি ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর মধ্যে শহরে ২০.৭৭ শতাংশ, গ্রামে ২৪.১২ শতাংশ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১.৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয় রংপুর বিভাগের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বেশি। এ বিভাগে প্রতি ১০০ জনে ২৯.৯৮ জন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। সিলেটে ১০০ জনে ১.৪২ জন তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ও বরিশালে রয়েছে ২২,৮৩ শতাংশ। দেশে গড় অতি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ০.৮৩ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অপুষ্টিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। শুধু তাই নয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখনো ৪৮টি সূচকে পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি। কিন্তু সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। অথচ প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে বলে জানা যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে অর্থনীতির আকার বড় হলেও আয়বৈষম্য ব্যাপক। এ বৈষম্য না কমালে জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দেশের অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেশকিছু পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা, ডলার সংকট ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। বিগত বছরগুলোয় বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ায় বেকারত্ব বেড়ে গেছে। ডলার সংকট সৃষ্টির কারণে আমদানিনির্ভর শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে। এতে কর্মসংস্থানের গতিও মন্থর হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২৪ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরে আমদানিতে বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যক্তিগত খরচ বা ভোগব্যয় বৃদ্ধির ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার কমবে। এজন্য সরকারকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ আদায় ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও নবগঠিত সরকার মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করেছে। কর্মসংস্থানের পূর্বশর্ত হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এজন্য বাস্তবমুখী কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। প্রশিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে এ খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। দুর্নীতি দমন করতে পারলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানও স্বাভাবিকভাবে বাড়বে। দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন করতে পারলে অর্থনীতির সব খাতেই মন্দাভাব কেটে যাবে, উন্ননের গতি ত্বরান্বিত হবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

৭ জানুয়ারি ২০২৪-এ অনুষ্ঠিত দ্বাদশ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে যে দুটি বিষয় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কর্মোপযোগী শিক্ষা এবং যুবক-যুবতিদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতির মন্দা প্রভাব, ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বড় বড় শিল্পের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। সার্বিকভাবে বড় শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা তাদের ক্ষতি কাটিয়ে সামনে এগোতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ আমরা জানি, স্বল্প পুঁজিতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। সেকারণে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের ও ডলারের দাম বৃদ্ধিতে শিল্পের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে; ফলে এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। একদিকে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা ও চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমেছে; অন্যদিকে আয় কমাতে স্বাভাবিকভাবে মানুষের ভোগও কমে গেছে। এতে উৎপাদনও কমেছে। শিল্পের জন্য যে কাঁচামালের প্রয়োজন, তা মূলত বিদেশ থেকে আনতে হয়। সেজন্য প্রয়োজন ডলারের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো ডলারের জোগান দিতে পারছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বর্তমান সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলার সংকট মোকাবিলা করা। মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়ন রোধ করা, রিজার্ভের হার বৃদ্ধি করা, দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য যথাযথ এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। উল্লিখিত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বর্তমান সরকার উন্নয়নের আর এক ধাপে এগিয়ে যেতে পারবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

 

মনজু আরা বেগম : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম