Logo
Logo
×

বাতায়ন

ইকোট্যুরিজম হতে পারে কক্সবাজারের প্রাণশক্তি

Icon

ড. মো. আবদুল লতিফ

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত, স্বচ্ছ নীল জলরাশি, ছোট-বড় পাহাড়বেষ্টিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ কক্সবাজারের সঙ্গে ১ ডিসেম্বর ২০২৩ রাজধানী ঢাকার বহু কাঙ্ক্ষিত রেল সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। দেশের সর্বদক্ষিণের এ জেলার সঙ্গে সারা দেশের রেল সংযোগ কক্সবাজারের পর্যটন খাতসহ বিভিন্ন সেবা ও পণ্য খাতের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যোগাযোগব্যবস্থার সম্প্রসারণ এ উপকূলীয় শহরের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় নবদিগন্তের সূচনা করবে, তা হলফ করে বলা যায়। এ পর্যটন শহরের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে এ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুণ্ন রাখা, উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন ও বিকাশের বিষয়গুলো যথাযথ বিবেচনার দাবি রাখে। এ জেলার সুষম ও সামগ্রিক উন্নয়নে ইকোট্যুরিজম হতে পারে প্রাণশক্তি।

সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেলপথের শেষ গন্তব্যস্থল কক্সবাজার রেলস্টেশনে আবাসনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত লকার ব্যবস্থা থাকায় সেখানে যাত্রীরা তাদের লাগেজ নিরাপদে রাখতে পারবেন এবং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, হিমছড়ি সমুদ্রসৈকত ও বন্যপ্রাণী পার্ক, ইনানী সমুদ্রসৈকত, মহেশখালী এবং সোনাদিয়া দ্বীপে নির্বিঘ্নে সময় কাটাতে পারবেন। এ রেল ভ্রমণ তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী, আরামপ্রদ ও নিরাপদ বিবেচনায় এ নগরীতে পর্যটকদের পদচারণা বৃদ্ধি পাবে। পর্যটন খাত ছাড়া রেল যোগাযোগব্যবস্থার ইতিবাচক প্রভাব কক্সবাজারের নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন: লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি, স্থানীয় পরিবহণ, নির্মাণ ও আবাসন খাতে পড়বে।

অন্যদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এ অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন ও উপভোগ করতে পারে, তার জন্য আমাদের অবশ্যই উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার্থে পর্যটন স্থানগুলোর প্রতিবেশগত ধারণক্ষমতা বিবেচনার দাবি রাখে। উল্লেখ্য, বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং সোনাদিয়া দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের ওপর পর্যটকদের কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে সরকার এসব এলাকাকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছিল। এ ভঙ্গুর উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ীভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। এসব সংবেদনশীল এলাকায় পর্যটকদের অপরিকল্পিত ভ্রমণ, মোটরবাইক চালানো, ঘোড়ায় চড়া, সৈকতে খেলাধুলা, অসতর্ক ও এলোমেলো গতিতে বোটিং, ডাইভিংয়ের মতো বিনোদনমূলক কার্যকলাপের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মাটি, সমুদ্রসৈকত এবং প্রবাল প্রাচীরের প্রাণীদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া অনেক পর্যটক প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে তাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং পলিথিনের খালি প্যাক যেনতেনভাবে এদিক-সেদিক নিক্ষেপ করে থাকেন। অসচেতন রেস্টহাউজ, কটেজ, রিসোর্টগুলোও তাদের উৎপাদিত বর্জ্য সরাসরি উপকূলীয় জলাশয়ে ফেলে দেয়।

বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে খাবারের সংস্থানের প্রয়োজনে স্থানীয় সামুদ্রিক মাছের চাহিদা বাড়ে, স্যুভেনির হিসাবে বিক্রির জন্য অতিরিক্ত প্রবাল সংগ্রহীত হয়। বিভিন্ন পর্যটনসংশ্লিষ্ট কার্যাদি স্বাদু পানির চাহিদা সৃষ্টি করে, যা পূরণ করতে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বাড়ে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, যা মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশে সাহায্য করতে পারে। এসব পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড উপকূলীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের জীবনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে, যা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করতে পারে। এটা সত্য যে, গণপর্যটন ব্যবস্থায় বর্তমান প্রজন্ম উপকূলীয় কক্সবাজার জেলার অকৃত্রিম প্রকৃতির অপরূপ রূপের আস্বাদন নিতে সক্ষম হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো নিরসনে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের টেকসই উন্নয়ন-অভিযাত্রায় ইকোট্যুরিজম হতে পারে সবচেয়ে জুতসই সমাধান। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি উন্নত জীবিকা উপার্জনেও ইকোট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাহাড়, বন-বনানী, বেলাভূমি, সমুদ্রসৈকতের ভূ-প্রকৃতিগত আকর্ষণ, প্রশান্তিদায়ক উপক্রান্তীয় জলবায়ু, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য, সহজগম্যতা এবং স্থানীয় জনমানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির কারণে এখানে ইকোট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। একই স্থানে বন্যপ্রাণী, প্রবাল প্রাচীর ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাবেশ অত্যন্ত বিরল, যার ফলে কক্সবাজারকে দেশের প্রধান ইকোট্যুরিজম হটস্পট হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

কক্সবাজারে ইকোট্যুরিজমের প্রসারে পরিবেশবান্ধব আবাসন নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির (যেমন: সৌর, বায়ু) ব্যবহার, পর্যটনভিত্তিক স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পর্যটকদের কাছে স্থানীয় সংস্কৃতি তুলে ধরতে হোটেলগুলোয় নানা ধরনের খাবার যেমন: ইলিশ, চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের হরেকরকম পদ, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি ভর্তার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যা আমাদের রন্ধনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প (যেমন: হ্যান্ডব্যাগ, খেলনা, নকশিকাঁথা এবং তাঁতের বস্ত্র), গহনার প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন সম্প্রসারণে কমিউনিটি হোম স্টে ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং আয়ের উৎস তৈরি হবে। আবার কমিউনিটি হোম স্টে উদ্যোগ স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা ইকোট্যুরিজমের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় পর্যটন নীতিমালা-২০১০’ প্রণয়ন করেছে। এ নীতিমালায় বাংলাদেশের পর্যটন এখনো ‘প্রারম্ভিক পর্যায়ে’ রয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। উপরিউক্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে পর্যটন এলাকা ও পর্যটন-আকর্ষণ চিহ্নিতকরণ, দেশের অঞ্চলভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকায় ইকোট্যুরিজম সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারকে একটি সুপরিকল্পিত পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কক্সডিএ) গঠিত হয়। কক্সবাজারের অন্তর্গত সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ও সংকটপূর্ণ এলাকা হওয়ায় ২০২৩ সালের মে মাসে সরকার এ দ্বীপ রক্ষার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর আওতায় দ্বীপের জমি, ভূমি উন্নয়ন ও অবকাঠামো (যেমন: রেস্টহাউজ, ডরমিটরি, হোস্টেল) নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য, পর্যটনসংক্রান্ত বিষয় এবং পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় মুখ্য ও সহযোগী বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিনির্দেশপূর্বক একটি নির্দেশিকা জারি করেছে। তবে ইকোট্যুরিজম বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এখনো যথেষ্ট জনসচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। উল্লেখ্য, সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত কক্সবাজারকে একটি টেকসই ও আধুনিক পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

আমাদের একটিই কক্সবাজার। পরিবেশের বহনক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সযত্নে আগলে রাখতে প্রণয়নাধীন কক্সবাজার মহাপরিকল্পনায় ইকোট্যুরিজমকে গুরুত্ব প্রদানসহ তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

ড. মো. আবদুল লতিফ : অতিরিক্ত পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম)

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম