Logo
Logo
×

বাতায়ন

জাত নিমের পাতা

গণতন্ত্র ও সুশাসনের দেশে পাক্কা এক মাস

Icon

মাহবুব কামাল

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণতন্ত্র ও সুশাসনের দেশে পাক্কা এক মাস

লন্ডনে জন্ম নেওয়া দশ মাস বয়সি পৌত্র চৌকসকে (নাতি-নাতনি পরিচয় কনফিউজিং। বোঝা যায় না তারা কি ছেলের সন্তান, নাকি মেয়ের। তাই ছেলের সন্তানের ক্ষেত্রে পৌত্র-পৌত্রী ও মেয়ের সন্তানের ক্ষেত্রে দৌহিত্র-দৌহিত্রী বলাই ব্যাকরণসিদ্ধ) দেখার ইচ্ছা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল স্ত্রীর, তখনও সেখানে যাওয়ার মনস্থির করতে পারিনি। দুই কারণে। প্রথমত, শরীরে স্পন্ডিলোসিসজনিত ব্যথা; দ্বিতীয়ত, সামনেই নির্বাচন, টেলিভিশনে কিছু কথা যদি বলা যায়। কিন্তু অচিরেই ভাবান্তর হয়, শরীর তো শরীরই, যা সওয়ানো যাবে, তাই সইবে। আর নির্বাচন? এ জাতিকে প্রভাবিত করার এখতিয়ার একমাত্র শেখ হাসিনার, আমরা কোন ছার? তাই চৈনিক তাওবাদী হয়ে যাও। পরিস্থিতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করো না, প্রবাহে গা ভাসিয়ে দাও। এই ভাবনায় সিদ্ধান্ত হয়, লাগাও ভিসা, কাটো টিকিট।

ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা বলতে হলে আলাদা একটি কলাম লিখতে হবে। যাহোক, পৌত্রকে দেখতে যাচ্ছি, এই আনন্দে ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’। অবশ্য কেউ একজন চিনে ফেলায় দুর্ভোগের কিছুটা লাঘব হয়। কয়েক ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে রিয়াদ বিমানবন্দরে ঢুকতেই ইচ্ছা জাগে বাইরে বেরিয়ে তেলের টাকায় বিন্যাসিত এই জাঁকজমকপূর্ণ শহরটিকে একটু দেখে আসি। কিন্তু মাত্র দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি, ট্রানজিট ভিসাও নেই। অতঃপর বিরতি শেষে কানেক্টিভ ফ্লাইটে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের দিকে টেক-অফ। স্ত্রী অস্থির আর আমি মনিটরে চোখ রেখে দেখে যাচ্ছি ইউরোপের কোন কোন দেশের ওপর তখন বিমান। একবার মনে হয়, ঝাঁপ দেব নাকি? যেখানেই ঝাঁপ দেব না কেন, কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবই। সুইজারল্যান্ডে ঝাঁপ দিলে রিয়া; জার্মানিতে সুলতানা আজীম, দেলোয়ার; সুইডেনে প্রিয় ছাত্রী প্রিয়াংকা; গ্রিসে আনোয়ার; ভিয়েনায় বুলবুল তালুকদার; ফ্রান্সে মোস্তফা।

হিথ্রোতে অপেক্ষমাণ ছেলে, বউমা ও তাদের আদরের ধন চৌকস। কিন্তু আমাদের তো ইমিগ্রেশন পার হতে হবে। নিতে হবে লাগেজ-বেল্ট থেকে লাগেজ। কোথায় উঠব, ইমিগ্রেশন অফিসারের এমন প্রশ্নে যখন বললাম, ছেলের কাছে এবং বউমা ইম্পেরিয়াল কলেজের একজন কমনওয়েলথ স্কলার, তিনি প্রায় চিৎকারে বলে উঠলেন, ওয়াও! প্রসঙ্গক্রমে বলি, বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের শাশুড়িকে ইমিগ্রেশন অফিসার একই প্রশ্ন করায় তিনি যখন বলেছিলেন, নাম্বার টেন ডাউনিং স্ট্রিট (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন), ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা প্রায় চটে গিয়ে বলেছিলেন, আর ইউ জোকিং উইথ মি? পরে ইনভেস্টিগেট করে সত্যতা যাচাইয়ের পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। লাগেজ নিয়ে বের হতেই অপেক্ষমাণ তিনজনের সাক্ষাৎ মেলে। চৌকস স্ট্রলারে ঘুমাচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকাতেই আলোর বিচ্ছুরণ চোখ ঝলসে দিল যেন। যাদের পৌত্র-পৌত্রী বা দৌহিত্র-দৌহিত্রী নেই, তাদের থিয়োরিটিক্যালি বোঝানো যাবে না ব্যাপারটা কী। পুরোটাই প্র্যাকটিক্যাল। বিমানবন্দরের একেবারে লাগোয়া টিউব রেলের স্টেশন। আমরা উঠে পড়ি, দেড় ঘণ্টার জার্নি শেষে নামব উডসাইড পার্কে, এরপর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ফিঞ্চলে, সেখানে ছেলের বাসা। টিউবে উঠতেই দেখি, ২৫ বছর আগে যখন আরেকবার এসেছিলাম, সেই একই চিত্র, একটা ব্যতিক্রম বাদে অবশ্য। সেই পরিচ্ছন্নতা, সেই সময় ধরে এগিয়ে চলা, সেই পরের স্টেশনের নাম কী, কোথায় যেতে চাইলে কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, মাইল্ড লাউড স্পিকারে এমন সব ঘোষণা। আসলে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো এর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মনে হচ্ছে, আমি যেন গতকালই এসেছিলাম লন্ডনে। কম্পার্টমেন্টের যাত্রীরা মাল্টি-ন্যাশনাল। বিরক্তিকর শব্দের বালাই নেই, কে বেশি সুনাগরিক, সেই প্রতিযোগিতা হতে পারে অবশ্য। কয়েকদিন পরে টিউবে চড়ে হয়েছিল আরেক অভিজ্ঞতা। দরজার সামনে এক যুবক-যুবতী যেভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কথা বলছিল, মনে হচ্ছিল দুজনে মিলে যেন জন্ম নিয়েছে দুপিঠওয়ালা এক প্রাণী। কিন্তু সেদিকে কেউ তাকাচ্ছিল না। আমার দেশে ধর্ষণের খবরে কেউ বিচলিত হয় না, সবাই ভাবে এ দেশে এ তো হয়েই থাকে, বিপরীতে কোনো নর-নারী কথা বলার সময় অন্তরঙ্গটা একটু বেশি হয়ে গেলে চারদিকে একটা রব ওঠে, দেশটা উচ্ছন্নে গেছে। ব্রিটেনে সেক্সচুয়াল হ্যারাজমেন্ট মারাত্মক অপরাধ; কিন্তু উভয় পক্ষের সম্মতিতে কোনো কিছুই আমলযোগ্য নয়।

ও হ্যাঁ, মাঝখানে একটি ব্যতিক্রমের কথা বলেছিলাম। ২৫ বছর আগে টিউবের ৮০ শতাংশ যাত্রীর হাতেই দেখেছিলাম, সময়টা সন্ধ্যা হলে লন্ডন ইভনিং পত্রিকা আর অন্য সময় হলে গার্ডিয়ান অথবা কোনো একটি পেপারব্যাক। নিমগ্ন হয়ে পড়তেন সবাই। এবার দেখলাম, কারও হাতেই পত্রিকা কিংবা বই নেই, ব্যতিক্রমহীনভাবে সবার হাতেই মোবাইল। শুধু কানটা খাড়া ঘোষণার দিকে, তার স্টেশন কতদূর, তা জানতে। আর বাকি সব ইন্দ্রিয় মোবাইলে। এ প্রসঙ্গে একটু বলে নিই। এবার লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে একটা মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বসেছিলাম। সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। এক সদস্য আমার উত্তর চেয়ে ইমিডিয়েট পাস্ট প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রুসের একটি উপলব্ধির কথা বললেন। লিজ প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন যে, প্রিন্ট মিডিয়া উঠে গেলে ব্রিটেনের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া যেহেতু আনএডিটেড অবস্থায় খবর বা ইভেন্ট প্রচার করে, তাই মানুষ এই মিডিয়াকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। আর প্রিন্ট মিডিয়া নানাস্তরে এডিটেড হয় বলে মানুষ এটাকেই বিশ্বাস করে। তবে নিজের অ্যাক্টিভিটি চালাতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা। সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণ যেভাবে এখন আসক্ত, তাতে প্রিন্ট মিডিয়াকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। লিজ ট্রুস প্রিন্ট মিডিয়া রক্ষায় একটি কমিশনও গঠন করে দিয়েছেন। আলোচ্য সাংবাদিকের এই বর্ণনার পর আমি যা বলেছিলাম, তা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র কলাম লিখব, শিগ্গিরই।

রক্ষণাবেক্ষণের কথাও বলছিলাম একটু আগে। ব্রিটিশরা রক্ষণশীল জাতি বলেই কি সবকিছু রক্ষা করে চলেছে? যুগের প্রয়োজনে হাইরাইজ তো একটা প্রয়োজন বটেই; কিন্তু সমগ্র লন্ডনে হাইরাইজের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। সেই মান্ধাতার আমলের ৮-১০ বুক উঁচু সমান বাড়িগুলো এখনো তেমনই আছে। দেশটিতে রক্ষণশীল নামের দলও আছে, যে দল এখন ক্ষমতায়। তারা রাজতন্ত্রকেও রক্ষা করে চলেছেন। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি মিশরে বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান হওয়ার পর কথা উঠেছিল, পৃথিবীতে সব রাজতন্ত্রই একসময় উঠে যাবে, থাকবে শুধু পাঁচটি রাজতন্ত্র। তাসের চার রাজতন্ত্র ও ব্রিটেনের রাজতন্ত্র। হ্যাঁ তাই তো, এই তো তিন বছর আগে বার্বাডোসের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশরা যে রাজতন্ত্রের প্রতি কতটা অনুরক্ত, তার একটা উদাহরণ শুনলাম প্রীতিভাজন রতনের মুখে। সে রয়্যাল পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। এই সংস্থার গাড়িতে রাজপরিবারের স্টিকার লাগানো থাকে আর গাড়িটি মিসপার্কিংসহ কোনো ট্রাফিক আইন ভাঙলে জরিমানা দিতে হয় না। সামগ্রিক মানবাধিকারের দিকে তাকালে এ বৈষম্য যেন সুস্থ, সবল, নীরোগ দেহে এক ক্রনিক অ্যালার্জি।

ফিঞ্চলের যে জায়গাটায় ছেলের বাসা, সেটি মূলত ইহুদিদের এলাকা। কয়েকজন বিদেশি স্কলার বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন সেখানে। আমার বউমা যেহেতু একজন বিদেশি স্কলার, তাই সে-ও বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। লন্ডনে পৌঁছার পর তিনদিন পর্যন্ত দীর্ঘ জার্নিজনিত শরীরের ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় কোথাও যেতে পারিনি। ভেবেছিলাম, এ সময়টায় প্রতিবেশী ইহুদিদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বুদ্ধিমান হিসেবে খ্যাত এ জাতির বুদ্ধিটা একটু যাচাই করব। কিন্তু ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে আমার এই ভাবনার কথা পড়ে তেরো বছরের সহকর্মী ইহুদি-বিশেষজ্ঞ আসিফ রশীদ যখন প্রতিক্রিয়ায় লিখলেন, বুদ্ধিতে ইহুদিরা আপনার কাছে কিছু না, তখন আর সে পথ মাড়াইনি। ব্যথা কমে যাওয়ার পর এক ঘণ্টার ড্রাইভে গেলাম লন্ডনস্থ রংপুর সমিতির সাবেক সভাপতি রাজ্জাক সাহেবের বাসায়, দাওয়াতে। এরপর নানা কর্মকাণ্ড। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সঙ্গে মতবিনিময়, ইংল্যান্ডের আরেকটি বড় শহর লেস্টারে ভাতিজির বাসায় বেড়ানো, সেখান থেকে নিজে লেখক যেহেতু, স্ট্রাটফোর্ডে শেক্সপিয়রের বাড়ি, বিজ্ঞানমনস্কতার তাগিদে উলসথর্প ম্যানরে নিউটনের বাড়ি ও সেই আপেল গাছের কাছে, লন্ডনে ফিরে একজন সাবেক মার্ক্সবাদী হিসেবে হাইগেট সিমেট্রিতে কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে, আরও কত জায়গায়! তবে সময়াভাবে যাওয়া হয়নি অ্যালথ্রোপে বিশ্ববাসীর ভালোবাসার পাত্রী ডায়ানার সমাধিতে, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ডারউইনের সমাধিতে, চার্চিলের ওয়ার রুমে। ডারউইনের মতবাদ বিতর্কিত বটে, তবে মানুষের চার্চভিত্তিক চিন্তাকাঠামোকে তিনিই প্রথম আঘাত করেছিলেন। লর্ড ক্লাইভের সমাধিতে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে না গিয়ে গিয়েছি বাকিংহাম প্যালেসের কাছাকাছি থাকা তার মূর্তির কাছে। ফেসবুকে ক্লাইভের কবরে যাওয়ার কথা পড়ে দু-একজন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। এদেশের মানুষ সাধারণভাবে খুব সহজেই মন্তব্য করতে পটু। ক্লাইভের কবরে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য তো ছিলই। আমাদের ইতিহাসের এক বড় খলনায়ক ক্লাইভকে বর্তমান ব্রিটিশ সরকার ও জনগণ কী চোখে দেখে, সেটাই বুঝতে চেয়েছিলাম তার কবরের প্রতি যত্ন অথবা অযত্ন দেখে। হ্যাঁ, ক্লাইভ ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থে নয়, নিজে ফুলে-ফেঁপে ধনী হওয়ার জন্যই এই বাংলার কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করে আড়াই শ বছর আগে ফিরে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। এই লুণ্ঠনের কুফল ভোগ করেছি আমরা তার প্রস্থানের মাত্র তিন বছরের মাথায়। ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হয়েছিল বাংলাকে। ইতিহাসের পাতায় থাকা ‘গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন’ নামের এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। ক্লাইভকে জবাবদিহির আওতায়ও আনা হয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। তবে ক্লাইভের ব্যাপারে ব্রিটিশদের বর্তমান চিন্তা নেতিবাচক নয়, আর তাই সসম্মানে স্থাপন করা হয়েছে তার মূর্তি। সেই মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আমার এক দুর্দান্ত পাঠক আবদুল্লাহ আল মামুনের অনুরোধে তাকে কিছু কথা শুনিয়ে এসেছি। এসব কর্মকাণ্ড ছাড়াও এটিএন বাংলা ইউকের লন্ডন স্টুডিওতে দিয়েছি এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, কন্টিনেন্টাল ইউরোপের শুদ্ধস্বর ডট কমে অংশ নিয়েছি টকশোয়ে, ঢাকার কয়েকটি টেলিভিশনেও যুক্ত হয়েছি জুমে। স্ন্যাক্স আর কফি অথবা ডিনার খেতে খেতে আড্ডা মেরেছি আমার অতিপ্রিয় এটিএন বাংলা ইউকের জোহা, রতন, বুলবুলসহ লন্ডনের আরও অনেক পরিচিতের সঙ্গে। ব্রিটিশরাও বাদ যায়নি।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। টুরিস্টদের জন্য লন্ডনের একটি অতি আকর্ষণীয় জায়গা হলো মাদাম তুসে। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন সেক্টরের বিখ্যাত লোকদের এমন সব মোমের মূর্তি রয়েছে যে, মনেই হবে না ওগুলো মূর্তি, জীবন্তই দাঁড়িয়ে আছেন যেন! তো ১৯৯৮ সালে প্রথমবার মাদাম তুসেতে গিয়ে দেখি, রাজীব গান্ধীর মূর্তি রয়েছে সেখানে, বেনজীর ভুট্টোও আছেন। কিন্তু নেই বঙ্গবন্ধু! রাগে-ক্ষোভে মন্তব্য বইয়ে লিখেছিলাম: An incomplete display without having Sheikh Mujibur Rahman. এবার গিয়েও যখন শুনলাম, এখনো বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন করা হয়নি, বিষয়টি নিয়ে বাধালাম হইচই। সাংবাদিক মহলে উত্তেজিত হয়ে বলেছি, আপনারা এখানে বসে বসে কী করেন? আশ্চর্যই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু কি তবে বেনজীরের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন? মনে পড়ে যায়, গতবার লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারে যাওয়ার পথে ট্রেনে এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ যুবতী সাবিহা বলেছিল, সে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধুকে চেনে না, তসলিমা নাসরিনকে চেনে! লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাজটাই বা কী! অবশ্য যে হাইকমিশন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মিষ্টি বিলিয়েছিল, সেই কমিশনের কাছ থেকে কী এমন আশা করা যায়! সেটা আরেক কাহিনি। এখন বলা যাবে না।

লেখাটা স্থানাভাবে দ্রুতই শেষ করতে হবে। তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি শিরোনামে। ক্লিনটন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমেরিকার শক্তির উৎস কী। তিনি বলেছিলেন: ইমিগ্রেশন অর্থাৎ অভিবাসন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, বিভিন্ন জাতির মেধা, বুদ্ধি ও শ্রমের সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে আমেরিকা। আমি তার এই কথার বিরোধিতা করে লিখেছিলাম, আসলে দেশটির শক্তির রহস্য হচ্ছে, It is a faceless society, এটা একটা মুখাবয়বহীন দেশ। কারও কোনো মুখাবয়ব নেই যে, দেখে চেনা যাবে তিনি অর্থবিত্তের মালিক, নাকি কোনো প্রভাবশালী বা প্রভাবশালীর আত্মীয়। এসব বিচারে তাকে প্রমোট করার বা বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই সেখানে। যোগ্যতাই আসল কথা। আর এ কারণেই ম্যাডোনার মতো একজন স্ট্রিটগার্ল মহা সেলিব্রিটি হতে পেরেছেন। ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও একই কথা। যোগ্যদের প্রমোট করতে হয় না আর এভাবে যোগ্য আর যোগ্য মিলে তৈরি হয় এক বড় শক্তি। গণতন্ত্র ছাড়া এ প্রক্রিয়া যে কল্পনার বাইরে এক পা-ও ফেলতে পারবে না, তা বলাই বাহুল্য। যাহোক, ব্রিটেনে গণতন্ত্রটা কীভাবে ফাংশন করে, একটু বলি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি হেরে গিয়েছিল। ফলাফল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবন ছেড়ে সস্ত্রীক একটি হোটেলে বসে ভাবছিলেন, তারা কোথায় উঠবেন, কারণ লন্ডন শহরে তাদের কোনো বাড়ি নেই। বিজয়ী কনজারভেটিভের নেতা চিরকুমার এডওয়ার্ড হিথ, যিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি তো আপাতত আমার কান্ট্রি হোম চেকার্সে গিয়ে উঠতে পারো। উইলসন সেটাই করেছিলেন। আজ এত বছর পর রাজনৈতিক অঙ্গনের সৌহার্দ খুব একটা কমেনি। বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও বিরোধী দল লেবার পার্টির নামই বলে দিচ্ছে প্রথমটি ঐতিহ্যপ্রবণ এবং সেই অর্থে ডানপন্থার আর দ্বিতীয়টি কিছুটা হলেও বামঘেঁষা। দুই দলের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। দ্বন্দ্ব আছে ব্রেক্সিট নিয়ে; সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে ইস্যুতে; প্রাইভেট সেক্টর, নাকি পাবলিক সেক্টরকে প্রমোট করতে, তা নিয়ে। কিন্তু এসব দ্বন্দ্বের চরিত্র অবৈরীমূলক (non-antagonistic)। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও বিরোধীদলীয় নেতা স্যার স্টারমারের মধ্যকার সম্পর্কে নেই কোনো তিক্ততা।

আর মানবাধিকার? বলা বাহুল্য, মানবাধিকার সুশাসনেরই নির্যাস। ব্রিটেনের মানবাধিকার ৩টি মোটা দাগে বিভক্ত। 1. Right to life 2. Right to respect for private and family life 3. Right to freedom of religion and belief. প্রায় অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করা হয় এসব অধিকার। ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলি, লেস্টারে গিয়ে দেখেছি শিয়া-সুন্নি, ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট, হিন্দু-বৌদ্ধ মিলেমিশে তৈরি হয়েছে কমিউনাল হারমোনির এক দৃষ্টান্তমূলক জায়গা।

ব্যবস্থাপনার কথা বলতে গেলে ছেলের পরিবারের ছোট্ট একটি ঘটনাই বুঝি যথেষ্ট হবে। বাসার চুলা ঠিকমতোই কাজ করছিল। বউমা তা পরিবর্তন করার প্রয়োজনই মনে করেনি। কিন্তু বাসার কর্তৃপক্ষ কীভাবে যেন বুঝে গেল চুলাটা বদলানো দরকার। এক মেকানিক এসে বললেন, তিনি পরদিন দুপুর দুটার সময় নতুন চুলা বসাবেন। পরদিন কাটায় কাটায় ঠিক দুটোয় তিনি দরজায় নক করলেন। আমি সামান্য বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, এক মিনিটও এদিক-সেদিক হলো না! আসলে ওই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ আগেই বাসার কাছে চলে এসেছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছেন পাঁচ মিনিট আগে নক করলে গৃহকর্ত্রী অন্যকাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন আর পাঁচ মিনিট পরে করলে দেখা যাবে তিনি হয়তো ওয়াশরুমে!

মাহবুব কামাল : সাংবাদিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম