শীতকাল ছোট হয়ে আসছে বলে অনেকে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে থাকি। যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন, তাদের সবাই বেজায় চিন্তিত না হলেও বুঝে উঠতে চান এর কারণ। তবে যারা এ বিষয়ের লোক নই, তাদের কেউ কেউ হয়তো আগ্রহী হয়ে উঠি শীতের অর্থনীতি নিয়ে। গ্রীষ্ম, বর্ষার মতো শীতেরও একটা অর্থনীতি রয়েছে এবং তার গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠা প্রয়োজন। যেমন, আমাদের প্রধান ধান-চাল উৎপাদন মৌসুম (বোরো) শুরুর আগে এর বীজতলা তৈরির এ সময়টায় শীত তীব্র হলে কীভাবে কী করতে হবে সে বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তারা দিচ্ছেন নির্দেশনা। এ সংক্রান্ত খবর মিডিয়ায়ও প্রচারিত হচ্ছে। তাতে বীজতলা রক্ষার বিষয়ে তারাও জানতে পারছি, যারা কখনো কোনোভাবেই কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ছিলাম না। তবে সন্দেহ কী, এসব পড়তে পড়তে ধান-চাল উৎপাদনের মতো জরুরি কাজের সঙ্গে অনুভব করছি গভীর একাত্মতা। চাল তো আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য আর খাদ্য নিরাপত্তায় রয়েছে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শীতে কাবু হয়ে সংবাদপত্র পড়তে পড়তে আমরা কি এ খবরও পড়ছি না-আমনের এ ভরা মৌসুমে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের সঙ্গে চালের দাম বাড়ছে নতুন করে? এ অবস্থায় বোরো উৎপাদন একটুখানিও ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না।
দেশের সবখানে তাপমাত্রা স্বভাবতই একইভাবে নেমে যায়নি; তবে অনেক অঞ্চলে শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। গ্রীষ্মে যখন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়, তখন আমরা ভুলে থাকি শৈত্যপ্রবাহের কথা। অবশ্য মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার মতো তাপমাত্রা নামেনি এখনো। তাতেও শীত অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে এবং লোকজন এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলছে। খবর হলো, অচিরেই বৃষ্টি হতে পারে দেশে এবং এ মাসের শেষ পর্যন্ত আরও তীব্র শীত আমাদের করে রাখতে পারে কাবু। এতে শীতজনিত অসুখবিসুখ আরও বেড়ে উঠবে, বিশেষত বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে। হাসপাতালে বাড়বে রোগীর চাপ। সবারই চেষ্টা থাকা উচিত শীতের এ ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে চলার। করোনায় ভুগে যারা ভেতরে ভেতরে কাহিল, তাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কারও অসুস্থতা মানে তো স্বজনদেরও পেরেশানি আর অর্থ ব্যয়ের চাপ।
শীতের এ সময়টায় বিশেষ করে মাথায় রাখতে হবে তাদের, যারা উপার্জনমূলক কাজে যেতে পারছে না কিংবা গেলেও কাজ পাচ্ছে না বা আগের মতো আয় করতে ব্যর্থ। তাদের কি সঞ্চয় রয়েছে খরচ করার? কেউ কি ধারকর্জ দেবে তাদের? সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অনেক বিস্তৃত এখন। এতে অনেকেই উপকৃত হচ্ছে সন্দেহ নেই। প্রতিবছর শীতে যারা উপার্জন করতে না পেরে বাড়তি সংকটে পড়ে কিছুদিনের জন্য, তাদের ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে? এ জনগোষ্ঠীর ভেতর কম্বলসহ শীতবস্ত্র বিতরণ করে তাদের সুরক্ষার কাজ বেড়েছে বৈকি। ব্যক্তিগতভাবেও সম্পদশালী অনেকে এটা করে থাকেন। তবে রাষ্ট্রের তরফে তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক সুরক্ষাও এ সময়ে প্রয়োজন। জানি না, আলাদা করে এমন কর্মসূচি আছে কি না।
দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না বলে সরকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে এবং এ লক্ষ্যে প্রকল্প চলমান। তবে আমাদের মতো দেশে কাজটি সহজ নয়। সে কারণে খোলা আকাশের নিচে থাকা গৃহহীনদের কথাই এখন বেশি করে মনে আসতে পারে তাদের, যারা দালানকোঠার মধ্যেও শীতের তীব্রতা অনুভব করছি। এ সময়ে ধুয়ে দেওয়া জামা-কাপড় সহজে শুকায় না বলে যারা অভিযোগ করি এবং অপেক্ষা করি সূর্যকিরণের, তারা কি অনুভব করতে পারি ওদের কষ্ট-তাপমাত্রা আরও নেমে আসার সময়টায় যাদের রাত কাটাতে হয় খোলা জায়গায়? তাদের কারও কারও মৃত্যুও ঘটে থাকে এ সময়ে। আসলে তারা মারা যায় অপুষ্টিতে আর শরীরে রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে বলে। শীত এসে হঠাৎ যে ধাক্কা দেয়, সেটা তারা সামলাতে পারে না।
এমন কোনো শীত কিন্তু পড়েনি দেশে। শীতপ্রধান দেশগুলোর যেসব খবর পাই, সেটা এখানকার তুলনায় ভয়াবহ। এমনকি নয়াদিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি শীত পড়েছে। এ-ও ঠিক, শীতের তীব্রতা বাড়ছে এ অঞ্চলে-স্থায়িত্ব কমে এলেও। সেটা ভালোভাবে মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। শুধু জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নয়; ফসল রক্ষায় দেখাতে হবে সাফল্য। মাঠে এ মুহূর্তে সবজিসহ যেসব ফসল রয়েছে, তার সুরক্ষায় কৃষি কর্মকর্তাদের বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এ শীতের মধ্যেই দেশে একটা নির্বাচন হয়ে গেল এবং নতুন সরকারে নতুন কৃষিমন্ত্রীও দায়িত্ব নিলেন। আমরা দেখতে চাইব এ সময়ে কৃষির সুরক্ষায় তার উপযুক্ত নেতৃত্ব। বোরোর বীজতলা রক্ষাসহ আলু, পেঁয়াজের মতো ফসলের উৎপাদনও ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না। শীতকালীন সবজির উৎপাদন এবারও ভালো; যদিও দাম অস্বাভাবিক রকম বেশি। শীতের প্রকোপে এর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে দাম আরও বাড়তে পারে। কৃষিতে এ সময়ে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা হয়ে ওঠে জরুরি। এক্ষেত্রে অল্প প্রয়াসও আমাদের দিতে পারে ভালো ‘রিটার্ন’।
শীতে জলাশয়গুলো শুকিয়ে মাছের সরবরাহ বাড়ে বলেও আমরা আশা করে থাকি, এ সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমে আসবে। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নাকি সত্যিই কিছুটা কমেছে। জানুয়ারিতে এটা আবার বেড়ে যেতে পারে। কারণ সবজির সঙ্গে চালের বাজারেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। মুরগির সঙ্গে মাছের দামও কিছুটা বেড়েছে। নতুন আলু ওঠার পরও এর দাম অন্যবারের মতো কমছে না। শীতের আগ দিয়ে ‘মুড়ি কাটা পেঁয়াজ’ উঠলেও এর আমদানি জটিলতায় অশান্ত হয়ে ওঠা বাজার শান্ত হয়ে আসতে সময় নিচ্ছে বেশি। রমজানে চাহিদা বাড়বে এমন সব পণ্যের দাম এখনই বাড়ছে নতুন করে। যেমন: ভোজ্যতেল, ডালজাতীয় পণ্য। এগুলোর সঙ্গে শীতের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। সম্পর্ক আছে বরং আমদানির। তবে শীতের প্রকোপে, বিশেষত কুয়াশায় পণ্য পরিবহণ বিঘ্নিত এবং এর ব্যয় বেড়ে গিয়ে থাকে। এর প্রভাব পড়ে পণ্যবাজারে। একে অজুহাত হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতাও কম নেই।
তারপরও শীতের জন্য আমরা অপেক্ষা করি; অপেক্ষায় থাকি নতুন ধান ওঠার। পিঠাপুলির জন্য অপেক্ষা বেড়েছে এমনকি শহরাঞ্চলে। পথের ধারে চিতই আর ভাপা পিঠা কতই না জনপ্রিয়! শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারী সদস্যরাও এসব বানিয়ে টাটকা গরম পরিবেশন করে দুটো পয়সা কামাচ্ছে। এত দুর্নীতি ও লুটপাটের মধ্যে তাদের টিকে থাকার প্রয়াস দেখলে চোখে পানি এসে যায়। শীতে হরেক রকম আর পরিমাণে অনেক বেশি উৎপন্ন হয় বলে এ সময়ে রিকশাভ্যানে সবজি বেচেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের কাছ থেকে কম দামেও পণ্য পাওয়া যায়। বৃষ্টিবিঘ্নিত হয় না বলে শীতের সময়টায় আরও কিছু খাতে কাজকর্ম বেড়ে ওঠে। যেমন: নির্মাণ ও মেরামতি। প্রতি অর্থবছরেই এ কমাসে এডিপির বাস্তবায়ন বাড়ে। তাতে বাড়ে কর্মসংস্থান। বাজারে বাড়ে অর্থ সরবরাহ। এ সময়ে নির্বাচনের কারণেও দেশে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। শহর থেকে গ্রামেও গেছে অর্থ।
বেদনাদায়ক যে, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাও চলছে অনেক স্থানে। এখন তো বরং বিয়েশাদি, পিকনিক ও মেলার মতো সম্মিলন আর সম্প্রীতির আয়োজন বাড়ার কথা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানও এ সময়ে বাড়ে। নতুন পাঠ্যপুস্তক পায় শিক্ষার্থীরা। এটা সব দিক দিয়েই বড় কর্মকাণ্ড। সামনেই, ফেব্রুয়ারিতে বসছে বইমেলা। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের। সেটাও ঘটেছিল শীতের মধ্যে। শীত এদেশে আন্দোলনেরও সময় বলে বিবেচিত। অবশ্য আগেকার মতো করে আন্দোলন রচনার সুযোগ কমে আসছে। ন্যায্য দাবি আদায়ে আলোচনার সুযোগ এখন বিস্তৃত করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উপলব্ধিটা জরুরি। সেটা গুরুত্ব পেলে আমরা বরং দেখব, শীতে পর্যটন বাড়ছে। আর রাজপথের কর্মসূচিতে সেটা ব্যাহত হচ্ছে না। এ খাতে কত মানুষ কতভাবেই না জড়িত এবং তারা অপেক্ষা করে থাকে শীতের এ সময়টার জন্য!
শীত যতই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসুক, এ সময়ে শীতবস্ত্রের ব্যবসাটা মন্দ হয় না। একসময় এক্ষেত্রে যে বিদেশনির্ভরতা ছিল, সেটা অনেকখানি দূর হয়েছে দেশ থেকে সরবরাহ আসছে বলে। তারপরও কিছু ভারী শীতবস্ত্র আসছে বিদেশ থেকে। এসবের দাম বৃদ্ধি ও ব্যবসা ব্যাহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যবসা কেমন হয়েছে, সেটা জানতে চাইব। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আগুনে পুড়ে যাওয়া স্মৃতিময় বঙ্গবাজারের কথা। ওখানকার বিক্রেতা ও তাদের ‘সাপ্লাই চেইনে’ যুক্ত ব্যবসায়ীদের কী খবর? তাদের কতজন পুষিয়ে উঠেছে ক্ষতি? কতজন গেছে হারিয়ে? শীতের সময়টায় এ ধরনের শপিং সেন্টার ও বসতিগুলোয় আগুন থেকে বাড়তি সতর্কতাও জরুরি।
শীতের প্রকোপে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণ আছে কি? হয়তো আছে। তবে সার্বিকভাবে এর সরবরাহ কেন কমেছে, সেটা আমরা জানি। দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসপ্রাপ্তি কমে এসেছে। বেড়েছে এলএনজিনির্ভরতা এবং তাতেও বেড়েছে জটিলতা। এতে গ্যাসনির্ভর শিল্প যেমন ভুগছে কঠিনভাবে; তেমনই ঘরবাড়িতেও পানি গরম করতে, এমনকি নাশতা তৈরিতে সংকটে পড়ছে মানুষ। বিকল্প জ্বালানির দিকে যেতে হচ্ছে বলে তাদেরও ব্যয় বাড়ছে এ কঠিন সময়ে। যন্ত্রণা বাড়ছে বিশেষ করে তাদের-এমন শীতেও যাদের রান্না করে খাওয়াতে হয় পরিবারের সবাইকে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক