নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশ ও পররাষ্ট্রনীতি
ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে জনগণের সর্বাত্মক ম্যান্ডেট পেয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছেন। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ২০২৪ সালে নতুন বছরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার যাত্রা শুরু করেছে। দেশ পরিচালনা এবং সংসদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৬ সালে তদানীন্তন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসাবে। এরপর এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। বিরোধী দলের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনার রয়েছে ৩২ বছরের অভিজ্ঞতা, যা বিশ্বে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে অনন্য। বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে সরকারপ্রধানের ইতিহাসে শেখ হাসিনা সম্ভবত সবচেয়ে অভিজ্ঞ।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। রূপান্তরিত বাংলাদেশের প্রধান কারিগর শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৫০৩ মার্কিন ডলার, যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে হয়েছে ২,৮২৪ ডলার। জিডিপির আকার পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেটের আকার দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি উৎপাদন, মানুষের গড় আয়ু থেকে শুরু করে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিটি খাতে নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটেছে। দারিদ্র্য ও অতি দরিদ্রতার হার যথাক্রমে ১৮.৭ ও ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এ পরিবর্তন বিশ্বের ইতিহাসে বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন। ১৯৬০-এর দশকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার দেশগুলোর বিস্ময়ক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সূচক পরিবর্তনের গতির বিচারে বাংলাদেশ অনন্য। মাত্র ১৫ বছরে একটি দেশের অর্থনীতির এত পরিবর্তন ইতিহাসে বিরল।
বাংলাদেশের এ সাফল্যের পেছনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যাপক অবদান রয়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতি, মানবতার কূটনীতি, জলবায়ু কূটনীতি, এমনকি কোভিড-১৯ টিকা কূটনীতিতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। ভূরাজনীতিকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির মঞ্চে বাংলাদেশের সাফল্যের অগ্রভাগে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের শীর্ষ কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বিরল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অঙ্গন ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাপক সাফল্যের অন্যতম শক্তি এবং কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশের নতুন পথ পরিক্রমায় পররাষ্ট্রনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে পররাষ্ট্রনীতি কিংবা কূটনীতির প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে দলের নির্বাচনি বিজয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, ত্রিশটির অধিক দেশের রাষ্ট্রদূতরা দেখা করেছেন, অভিনন্দন বার্তা জানিয়েছেন। কমনওয়েলথ, ইইউ ও ওআইসিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল প্রতিটি রাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ-বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন ও নতুন সরকার বিষয়ে গঠনমূলক ও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। প্রতিক্রিয়ার ভাষা ও বিষয়বস্তুর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ভারত, চীন এবং রাশিয়া জোরালোভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফলকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব দিলেও সার্বিকভাবে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছে। সব পক্ষই নতুন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউর বিবৃতির মধ্যেও বিষয়টি পরিষ্কার। ভারত, চীন ও রাশিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী ও অর্থবহ করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জন ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের বিষয়টি বিবেচনা করলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়।
এ প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দিকটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অসাধারণ রূপান্তরের কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতার এ বিশ্বে জাতীয় পর্যায়ে সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। তার ওপর রয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি। ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনা একের পর এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ, এফএও, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন সময় পুরস্কৃত করেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে টাইম ম্যাগাজিন শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রকাশ করে। ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্ব রাজনীতিতে নবম শক্তিশালী নারী হিসাবে আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনাকে। সার্বিক বিবেচনায় বিশ্বের শক্তিশালী ১০০ জন নারীর মাঝে শেখ হাসিনা ৪৬তম। ২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন অনুযায়ী বিশ্বের ২৯তম শক্তিশালী নারী হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে শান্তিরক্ষী বাহিনীসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, ফোরাম ও সেমিনারে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রদান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মূল দিকগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায়-তিনি চারটি বিষয়কে তার কাজের মাধ্যমে তুলে ধরেন। প্রথমত, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তিনি একজন সাহসী নেতা। দেশের ভেতরে ও বাইরে সর্বক্ষেত্রে তিনি অসম সাহস নিয়ে বিচরণ করেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে দরকষাকষি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ বা মতপার্থক্য বিষয়ে শেখ হাসিনার অবস্থান, কোভিড-১৯ বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও একের পর এক মেগাপ্রোজেক্ট বাস্তবায়ন, দেশের দারিদ্র্যের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই তার গৃহীত নানা পদক্ষেপের মধ্যে। বিশ্ব যখন চতুর্থ থেকে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের নিয়ে চলেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে। সুনীল অর্থনীতি নিয়ে যখন আলোচনা চলছে বিশ্বব্যাপী, তিনি দিয়েছেন ডেলটা প্ল্যান ২১০০, যেখানে পরিকল্পনা রয়েছে পুরো এ বদ্বীপকে কেন্দ্র করেই। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার যুদ্ধে যখন গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটি একটি উসকানিমূলক পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে। আর তার ফলে আমরা দেখতে পাই, এবারের দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভের পর মিয়ানমারের শুভেচ্ছা বার্তা। শেখ হাসিনা এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য, এ ধ্রুব সত্য মিয়ানমারও হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ধারাবাহিকতা ও এগুলোর ব্যবস্থাপনা লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সেখানেও রয়েছে তার দূরদর্শিতার ছাপ।
দেশপ্রেম তার নেতৃত্বের তৃতীয় স্তম্ভ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তার বাংলায় বক্তব্য এর বড় উদাহরণ। যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর থাকা, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরাসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেখা যায় তার দেশপ্রেমের নিদর্শন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় তার নিরলস প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে নানাবিধ সম্মানজনক অর্জন। সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এর প্রমাণ বহন করে। চতুর্থত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেখা যায় মানবিকতার নানা দিক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ করলে দেখা যাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এখানে আশ্রয় লাভ মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। প্রায় ১২ লাখ জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা, যেখানে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিুমুখী, এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যেখানে অন্যতম প্রধান সংকট অর্থায়ন, এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, ‘আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাবার দেই। সুতরাং বিপদে পড়ে আমাদের দেশে আসা দুই-পাঁচ-সাত লাখ মানুষকে খাবার দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের আছে।’ শুধু একজন মানবিক নেতাই পারেন এমনটা করতে। এ ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তার অবস্থান সবসময়ই মানবিকতার পক্ষে। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের অবস্থান প্রকাশ করছে নানাদিক মাথায় রেখে, শেখ হাসিনার অবস্থান একটাই-মানবতা রক্ষা।
তাই বলাই যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশসহ বিশ্বরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে চলেছে। নানা ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব তাই রোলমডেল। আর বাংলাদেশও সেই নেতৃত্বে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে আরও বহুদূর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো আগামী দিনে বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা রাখবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে, শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে সেদিকে দেশ এগিয়ে যাবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়