Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশার আলোয় উদ্ভাসিত হোক বড়দিনের আনন্দ

Icon

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আশার আলোয় উদ্ভাসিত হোক বড়দিনের আনন্দ

বিশ্ব আর্থসামাজিক ও রাজনীতির এমন এক প্রক্ষেপণ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আজ আমরা বড়দিনের উৎসব উদযাপন করছি, যখন একদিকে শাসকশ্রেণি, অন্যদিকে শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রেণি; একদিকে মানুষের বিত্তবৈভবের অঢেল বিলাসিতা, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ; একদিকে সম্পদের প্রাচুর্য, অন্যদিকে দরিদ্রের কশাঘাত; একদিকে যুদ্ধের দামামা, মারণাস্ত্রের উল্লাসনৃত্য, অন্যদিকে নিরীহ মানুষের বাঁচার আকুতি। এ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে যখন যিশুখ্রিষ্টের সূর্যালোকিত বাণী উচ্চকিত হয়-‘আমি জগতের আলো। যে আমার অনুসরণ করে, সে কখনো অন্ধকারে পথ চলে না’ (যোহন : ৮: ১২)। তখন বড়দিন নির্যাতিত-নিপীড়িত ও আর্তপীড়িত মানুষের মধ্যে নতুন জীবনের আশার আলো সঞ্চার করে।

প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য, সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধসংবলিত একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিষ্ট রক্ত-মাংসের মানবদেহ ধারণ করেছেন। সাধু যোহনের ভাষায়, ‘বাণী একদিন হলেন রক্ত-মাংসের মানুষ। বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তার মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম। একমাত্র পুত্র হিসাবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া যে মহিমা, ঐশী অনুগ্রহ ও সত্যের সেই যে পূর্ণতা’ (যোহন : ১:১৪)। ইহুদিদের শনিবারের প্রার্থনাগারে যিশু যখন প্রথম নিজেকে ঈশ্বরের মনোনীত বলে ঘোষণা করেন, তখন তার প্রথম বাক্যটি ছিল-‘প্রভুর আত্মিক প্রেরণা আমার ওপর নিত্য-অধিষ্ঠিত, কারণ প্রভু আমাকে অভিষিক্ত করেছেন। তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন দীনদরিদ্রের কাছে মঙ্গলবার্তা প্রচার করতে, বন্দিদের কাছে মুক্তি আর অন্ধের কাছে নবদৃষ্টি লাভের কথা ঘোষণা করতে, পদদলিত মানুষকে মুক্ত করে দিতে’ (লুক : ৪:১৮)।

সত্যিকার অর্থে উৎপীড়নকারীর অত্যাচার, সামাজিক অন্যায্যতা মানুষের পাপ আর অসত্যের অন্ধকারে নিমজ্জিতদের বিপরীতে যিশুখ্রিষ্টের সত্যনিষ্ঠ মানবতার বাণী সমাজে খেটে খাওয়া ক্রীতদাস, নিঃস্ব মজুর, কৃষক ও হতদরিদ্রসহ সর্বস্তরের মানুষকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিল। এ কারণে ‘ইলিশাবেৎ যখন মরিয়মের কাছ থেকে যিশুর আগমন বার্তা শুনেছিল, তখন যোহন বাপ্তাইজক আনন্দে নেচে উঠেছিল। শিমেয়োন জেরুজালেম মন্দিরে শিশু যিশুকে কোলে তুলে নিয়ে আনন্দে বলে উঠেছিল, ‘আমার নয়ন যুগল পরিত্রাণ দেখিতে পাইল’ (লুক : ২:১০)। আর তাই মুক্তিদাতার মর্ত্যলোকে আগমন উপলক্ষ্যে বড়দিনের এ উৎসব আমাদের মাঝে মুক্তির আশা জাগায়।

যিশুর মর্ত্যলোকে আগমন ঘটেছিল মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও জাগতিকমুক্তি সাধনের জন্য। আর এ নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গঠনের পূর্বশর্ত হলো মানুষকে ভালোবাসা। এ কারণে যিশুর শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্প্রীতিবোধ। তাই যিশুর নিদের্শ হলো-‘তোমরা একে অপরকে ভালোবাস। আমি যেমন তোমাদের ভালোবেসেছি, তেমনি তোমরাও অন্যকে ভালোবাস।’ (যোহন : ১৫:১২)। যিশুর শিক্ষা হলো প্রতিশোধ নয়, ধৈর্য ও ক্ষমা-অন্যায়ের প্রতিদানে সক্রিয় উদার ভালোবাসা। তাই তিনি শত্রুদেরও ভালোবাসার শিক্ষা দিয়ে বলেন-‘তোমরা তোমাদের শত্রুকেও ভালোবাস; যারা তোমাদের নির্যাতন করে, তাদের মঙ্গল প্রার্থনা কর’ (মথি : ৬:৪৪)। যিশুখ্রিষ্ট শুধু ভালোবাসার শিক্ষা দেননি বরং তিনি একে অপরকে ক্ষমা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার আধ্যাত্মিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেউ যদি ঈশ্বরের ক্ষমা পেতে চায়, তাকে অবশ্যই অন্যকে ক্ষমা করতে হবে। যিশু বলেন-‘তোমরা যদি পরের অপরাধ ক্ষমা কর তাহলে স্বর্গে বিরাজমান তোমাদের পিতাও তোমাদের ক্ষমা করবেন’ (মথি : ৬:১৪)।

যিশু জানতেন পার্থিব সম্পদের মোহ মানবাত্মার প্রধান শত্রু। তাই তিনি মানবজাতির জন্য প্রার্থনা করে বলেন-‘আমাদের প্রলোভনে পড়তে দিও না, বরং সেই মহা অসত্যের হাত থেকে রক্ষা কর’ (মথি : ৬:১৩)। পার্থিব সম্পদের চেয়ে যিশু ঐশ রাজ্যের জন্য সম্পদ আহরণের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-‘তোমরা নিজেদের জন্য এ পৃথিবীতে ধনসম্পদ সঞ্চয় কর না। কারণ এখানে পোকা আর মরচে সবকিছু নষ্ট করে দেয়। এখানে চোর এসে সিঁধ কেটে চুরি করে। তোমরা বরং ধনসম্পদ সঞ্চয় কর স্বর্গলোকে’ (মথি : ৬:১৯-২০)।

যিশুর আধ্যাত্মিক শিক্ষার একটি অন্যতম দিক হলো সর্ব অবস্থায় ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রাখা। আমরা যাই করি না কেন, আমাদের এ সংকল্প থাকা উচিত-আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সবকিছু করি। যারা জীবনের সব বিষয়ে ঈশ্বরকে প্রাধান্য দেয়, তারা শুধু ঐশ রাজ্যেই প্রবেশ করে না বরং তাদের পার্থিব জগতের প্রয়োজনীয় সব ঈশ্বরই প্রদান করেন। তাই যিশু শিষ্যদের শিক্ষা দিয়ে বলেন-“না, তোমরা এসব প্রশ্ন নিয়ে দুশ্চিন্তা কর না যে, ‘আমরা কী খাব?’ বা ‘কী পান করব?’ কিংবা ‘কী পরব?’ ধর্মবোধহীন মানুষই তো ওসব কিছুর পেছনে ছুটে মরে! তোমাদের যে ওসব কিছুর প্রয়োজন আছে, তা স্বর্গে বিরাজমান তোমাদের পিতা তো ভালোভাবেই জানেন” (মথি : ৬:৩১-৩২)।

যিশুখ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার চব্বিশ বছর পর আজও যখন পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত, হানাহানি আর আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা আর লোভ-লালসায় মানবতা ভূলুণ্ঠিত, তখন যিশুর এসব আধ্যাত্মিক বাণী আমাদের মধ্যে নতুনভাবে আশার আলো সঞ্চার করে।

ঈশ্বর আপন পুত্র যিশুর মধ্য দিয়ে স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যরে মানুষের মিলন ঘটিয়েছেন। ঈশ্বর স্বর্গে বিরাজমান। কিন্তু আমরা যিশুর নির্দেশিত ধর্মপথে তার জীবনদর্শন অবলম্বন করেই কেবল স্বর্গে আরোহণ করতে পারি। যিশু এ ধরাধামে এসেছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য। এ কারণে যিশুজন্মোৎসব উপলক্ষ্যে বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা যিশুর আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। অর্থাৎ সমাজ ও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই যে হানাহানি, জাতিতে জাতিতে লড়াই, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারে মানবতার বিপর্যয়-এর বিপরীতে সৌম্য, শান্তি আর ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে মানবতার জয় ঘোষণা করাই হচ্ছে বড়দিনের মূল শিক্ষা।

যিশুখ্রিষ্ট পৃথিবীতে এসেছেন শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য। ক্ষমা ও ভালোবাসার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তি সাধনের জন্য। তাই আমরা যখন বড়দিনের উৎসব পালন করি, তখন যেন পরস্পরের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির চেতনা লাভ করতে পারি, একে অপরকে ভালোবাসতে পারি, ক্ষমা করতে পারি, একে অপরের জীবনে আশার আলো হয়ে উঠতে পারি, তাহলেই বড়দিনের আনন্দ সার্থক হবে।

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি: অধ্যক্ষ, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম