প্রয়োজন প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি
জাকির হোসেন
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গ্লোবাল ইকোনমির এ সময়ে দেশ ‘ক্যাশলেস’ আর্থিক লেনদেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ডিজিটাইজেশন ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। নিশ্চিত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন ধারা। ডিজিটাইজেশন হচ্ছে যুগের দাবি। যে দেশ প্রযুক্তিতে যত এগিয়ে এবং যত দক্ষ জনশক্তির অধিকারী, সেই দেশের অর্থনীতি তত সমৃদ্ধ। প্রসঙ্গত, যদি জাপানের কথা ধরা হয় তবে বলব, দেশটি একদিনেই প্রযুক্তিতে এত বিকশিত হয়ে ওঠেনি। এজন্য তাদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই জাপানে নিম্নমাধ্যমিক স্তরে প্রযুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রযুক্তি শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে রাখা হয়। নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিতে হাতেকলমে শেখানো, যাতে ছাত্ররা তাদের সেই জ্ঞান দ্বারা আধুনিক যন্ত্র তৈরি এবং তা চালনার মাধ্যমে স্বকর্মে উজ্জীবিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, অভিজ্ঞ শিক্ষক গড়তে তিন বছর মেয়াদি প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়। কারণ, ছাত্রদের প্রযুক্তির ধারায় শিক্ষিত করতে প্রথমেই প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এ ধরনের একটি শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম কেমন হওয়া উচিত, তা জানতে পাঠ্যক্রম বিশেষজ্ঞদের যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। জাপানে ১৯৮০ সালে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা কোর্সের প্রচলন করা হয়। আবার উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দেওয়া হয় Mechanics ও Electronics-এর সমন্বয়ে গঠিত কোর্স। এভাবেই জাপানে শিক্ষা কার্যক্রম সংস্কার করে তা সময়োপযোগী করা হয়েছে। আর শুধু বইপত্রের জ্ঞান দিয়েই তাদের শিক্ষা দেওয়া হয় না, বরং হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই যন্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে, চালনা এবং নানা সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারে। জাপান এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমেই প্রযুক্তিতে এত উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশেও কারিগরিসহ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশাল। বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি দেশের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করছে ঠিক; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কর্মহীন বেকারে পরিণত করছে। বাস্তবভিত্তিক কর্মদক্ষতা না থাকায় এসব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিলেও সেই জ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মোপযোগী হয় না। অথচ বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কোর্স যেমন কম্পিউটার স্পেশালিস্ট, ওয়েব ডেভেলপার, অটোমেশন কন্ট্রোল, মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, অর্গানাইজেশনাল স্কিল, মেইনস্ট্রিম প্রভৃতি কোর্স জানা থাকলে পেশাগত জীবনে তা কাজে লাগে। এছাড়া একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও দেখা যায়, মাতৃভাষা বাংলার বাইরে প্রয়োজনীয় ভাষা না জানা থাকায় বিদেশে কিংবা দেশেই উন্নত প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি, জাপানিজ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, আরবি, উর্দু ও হিন্দি ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে। দেশের বাইরে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা একজন শিক্ষিত তরুণের জন্য অনেক সহায়ক হতে পারে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতেও দেশে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির ব্যাপক প্রয়োজন।
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল ভিশন এবং উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের ‘ডিজিটাল রূপান্তর ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শীর্ষক গবেষণাপত্রেও এর উল্লেখ রয়েছে। স্বাধীনতার অর্ধশতকে এসে আগের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ধীরে হলেও এ উন্নয়নের সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশে বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে ব্যাংকিং, নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে ডিজিটাল কার্যক্রমের ধারা সংযোজিত হচ্ছে। একইভাবে বেসরকারি উন্নয়ন খাতেও এর প্রচলন শুরু হয়েছে। শাখাবিহীন ব্যাংকিংয়ের প্রসারের মাধ্যমে ডিজিটাল আর্থিক অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রযুক্তিগত এই পদ্ধতি দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এক যুগান্তকারী ধারা সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষের দোরগোড়ায় খুচরা ব্যাংকিংয়ের পূর্ণ পরিষেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) গ্রাহক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ১০ কোটির বেশি মানুষ এ সুবিধার আওতায় এসেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শুরু থেকেই জড়িত। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স এবং কৃষি ঋণের একটা বিরাট অংশ তারা সরাসরি কিংবা মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে উপকারভোগীকে পৌঁছে দিয়ে থাকে।
মূলত ডিজিটাল ফিন্যান্সের মতো আর্থিক পরিষেবা গ্রহণের জন্য বা এর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য কাউকে ব্যাংকে যেতে হয় না। ঘরে বসেই এ সেবা পাওয়া যায়। এককথায় বলা যায়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অর্থাৎ এমএফএস-এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা এখন হাতের মুঠোয়। ঘরে বসেই এখন এমএফএস-এর মাধ্যমে বিভিন্ন বিল পরিশোধ, নিজ ব্যাংক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে টাকা হস্তান্তর করা যায়। বর্তমানে দেশের বেসরকারি উন্নয়ন খাতের অনেক মাইক্রো ফিন্যান্স ইনস্টিটিউট (এমএফআই) মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা তাদের লাখ লাখ গ্রাহকের লেনদেন এ এমএফএস-এর মাধ্যমে করছে। এতে লেনদেনে যেমন স্বচ্ছতা চলে এসেছে, তেমনই বাড়তি খরচ করে কারও সংশ্লিষ্ট শাখায় যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল; কিন্তু বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির ছোঁয়া বেশ সাবলীলভাবেই পড়েছে। আমরা ডিজিটাল ফিন্যান্সের যুগে পদার্পণ করেছি। এ আর্থিক পরিষেবা ব্যক্তি এবং ব্যবসাগুলোকে আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করতে এবং আর্থিক পণ্য এবং পরিষেবাগুলো অনলাইনে পরিচালনা করতে সক্ষম করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল ওয়ালেট, মোবাইল ব্যাংকিং অনলাইন পেমেন্ট, রোবো, অ্যাডভাইজার এবং আরও অনেক কিছু। যে কোনো ব্যাংক হিসাবের ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে ক্যাশলেসভাবে Transaction, Bill Pay, Recharge, Add Money, Statement, E-Statement, Bank Deposit, Cards, Tap and Pay, Send Money, Inbox, Live Chat ইত্যাদি মুহূর্তেই করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে হাঁটছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছোট-বড় পণ্য কেনাবেচার জন্য এখন আর সরাসরি ভোক্তা-বিক্রেতার উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না, ডিজিটালেই তা করা যায়। সবাইকে যখন ডিজিটাল লেনদেনের আওতায় আনা যাবে, তখন আর ক্যাশ আউটের প্রয়োজন হবে না। একই সঙ্গে সবাইকে ডিজিটাল লেনদেনের আওতায় আনা হলে আর্থিক খাতের দুর্নীতিও অনেক হ্রাস পাবে-এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ডিজিটাল পেমেন্টের সমস্যার সমাধান যেমন জরুরি, তেমনই এর পরিধি আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু এ সিস্টেমটি মোবাইল টু মোবাইলের মাধ্যমে পরিচালিত, সেক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি ও আর্থিক সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য তদারকি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা দরকার। লক্ষণীয়, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এদেশে ইন্টারনেট সেবার ব্যয় বেশি, তা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। মোবাইল অপারেটরদের ক্যাশ আউট চার্জ কমানোর বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী এবং ইতোমধ্যে তারাও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় নারীর অংশগ্রহণ ও নারী এজেন্টের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রাহকদের সিআইবি প্রতিবেদন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাহকদের জন্য ডিজিটাল লোন ও অন্যান্য সেবা গ্রহণের সুবিধা সহজতর করতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রাহকদেরও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে তাদের পক্ষেও জীবনযাপনের অনেক কাজ সহজভাবে করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশও অতি দ্রুত উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
ডিজিটাল লেনদেনে যাওয়ার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, এতে সব লেনদেনের রেকর্ড থাকে। ডিজিটাইজেশনের ফলে ভুলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কারণ প্রযুক্তির কাজ নির্ভুল হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাসহ জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রদানে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এর বাস্তবায়ন হলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি।
জাকির হোসেন : নির্বাহী পরিচালক, ব্যুরো বাংলাদেশ