কী আছে নতুন ঔষধ ও কসমেটিকস আইনে
মো. নুরুল আলম
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ জীবন বাঁচাতে এবং জীবন সাজাতে ওষুধ ও প্রসাধনীসামগ্রীর ব্যবহার করে আসছে। যুগের উৎকর্ষতায় কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত সংযোজিত হচ্ছে নিত্যনতুন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে বিশ্ববাসী তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে এ মহামারি থেকে। বিশ্বখ্যাত কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের নাম এ প্রজন্ম বহুদিন মনে রাখবে।
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোভিড মহামারি চলাকালে জীবনরক্ষাকারী Remdesivir নামের ওষুধ দ্রুত উৎপাদন ও বাজারজাত করে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। এছাড়া দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধের জোগান দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের মানসম্মত ওষুধ এখন রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ওষুধের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। ২৩২টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৫৪ ইউনানি, ১৬৪টি আর্য়ুবেদিক, ৫৩টি হোমিও এবং ৩৬টি হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ৫১,৩২৫ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করছে। বর্তমানে দেশে রেজিস্টার্ড ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় ২,০৫,৫৮৯। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ঔষধ প্রশাসন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে Drug Act 1940 এবং ১৯৮২ সালে Drug Control Ordinance প্রণয়নের মাধ্যমে ওষুধের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, মূল্য নির্ধারণ, আমদানি-রপ্তানিসহ বিবিধ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। তবে উল্লেখিত আইনগুলোতে নানা অসংগতি এবং নিত্যনতুন ওষুধের গবেষণা, উদ্ভাবন, নকল-ভেজাল ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে Drug Act 1940 এবং Drug Control Ordinance 1982 রহিতক্রমে যুগোপযোগী ‘ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩’ ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাশ হয়। এটি জাতীয় সংসদে পাশকৃত বাংলা ভাষায় প্রণীত একমাত্র ঔষধ ও কসমেটিকস আইন। এ আইনে ঔষধ ও কসমেটিকস বিষয়ের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-১. নকল, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন, মজুত, বিক্রয়, বিতরণসহ অসৎ উদ্দেশ্যে ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফার অভিপ্রায়ে মজুত করা সম্পর্কিত গুরুতর অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক WHO prequalified drug regulatory authority হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য WHO-এর চাহিদা মোতাবেক ফার্মাকোভিজিল্যান্স, ভ্যাকসিনের লট রিলিজ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইত্যাদি বিষয়গুলো আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে, WHO Maturity Level-3/ WHO prequalified drug regulatory authority হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হবে ও বাংলাদেশে উৎপাদিত ভ্যাকসিন রপ্তানি করা যাবে এবং দেশের EPI Programme এ ভ্যাকসিন ব্যবহার করা যাবে। ৩. WHO-এর মতে, প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সজনিত কারণে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বড় উদ্বেগের কারণ হলেও পূর্বের আইনগুলোতে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিধিবিধান ছিল না। জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধের লক্ষ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেটে লাল রংয়ের মার্কিংয়ের নির্দেশনাসহ রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্য্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। ৪. আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় ওষুধের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জীবনরক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস যেমন-Cardiac Stent, Heart Valve, Intraocular Lens ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এগুলোর ব্যবহার বর্তমানে ওষুধের সমপর্যায়ে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই Regulatory Authority ওষুধের সঙ্গে মেডিকেল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই এ আইনে মেডিকেল ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৫. আদালতে মামলা না করেও ঔষধ পরিদর্শকরা তফশিলে বর্ণিত ১৬টি লঘু অপরাদের জন্য প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ করতে পারবেন। ৬. নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো ওষুধ তৈরির কাঁচামাল বিক্রয় করলে ২ বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ৭. আইনটির ৫৮ ধারাতে বলা হয়েছে, ঔষধ পরিদর্শকরা কোনো অভিযোগের তদন্তকার্য পরিচালনাকালে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ২(৮) ধারায় কসমেটিকসের সংজ্ঞা এবং ৫ম অধ্যায়ে ৩১-৩৫ ধারায় কসমেটিকসের লাইসেন্স, নিবন্ধন, উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তাছাড়া ৩৫(৩) ধারায় বিউটি পার্লারে কসমেটিকসের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার রোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হয়েছে। ৭৬(১) ধারায় কসমেটিকসের বিধি প্রণয়নসংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কসমেটিকস জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। নকল, ভেজাল, মানহীন কসমেটিকস ব্যবহারের ফলে স্কিন ক্যানসার, কিডনি-ফুসফুস ও লিভার ডিজিজ, চোখের ইনফেকশন, ইরিটেশন, হৃদরোগসহ নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই কসমেটিকসের মান, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা মূল্যায়নপূর্বক রেজিস্ট্রেশন প্রদান, উৎপাদনে Good Manufacturing Practices (GMP) Compliance (প্রতিপালন), কসমেটিকস্ পণ্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া/বিরূপ/ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন এবং তদানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ তথা Cosmetovigilance ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নকল, ভেজাল, মানহীন কসমেটিকস নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এ আইনে শাস্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কসমেটিকস সম্পর্কিত বিষয়গুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য ইস্যু হওয়ায় ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের রেগুলেটরি অথিরিটি ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কসমেটিকস নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ১৯৬২ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০ এ কসমেটিকস সংযুক্ত করে Drug and Cosmetics Act 1940 (Amendments)-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। বর্তমান আইনি কাঠামোতে ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর’ শুধু ওষুধসংশ্লিষ্ট প্রসাধনীসামগ্রীর নিয়ন্ত্রক সংস্থা; কিন্তু জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মেডিকেটেড ও নন মেডিকেটেড উভয় ধরনের কসমেটিকস কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কসমেটিকসের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার অবৈধ চোরাকারবারিদের দখলে। এ খাতের ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। ফলে ১০০০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। USFDA, EU, ASEANসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার মান অনুযায়ী, কসমেটিকসের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মহাখালীর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের National Drug Control Laboratory (NDCL) সংলগ্ন ৫ কাঠা জমি ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক বরাদ্দ করা হয়েছে। ২টি বেজমেন্টসহ ১২ তলাবিশিষ্ট Laboratory Complex ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ADB এর 50 million মার্কিন ডলার অর্থায়নসহ ৬১৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্পটি ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। খুব শিগগির ওই Lab Complex-এ কসমেটিকসের Quality, Safety, efficacy, Cosmetovigilanceসহ অন্যান্য পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।
পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ যথাযথভাবে কার্যকর করা গেলে তা নকল, ভেজালমুক্ত নিম্নমানের ওষুধ ও কসমেটিকসের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফলে দেশের জনগণের ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত ওষুধ ও কসমেটিকসপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। ওষুধের মতো মেডিকেল ডিভাইস, ভ্যাকসিন ও কসমেটিকস রপ্তানিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।
মো. নুরুল আলম : উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর