Logo
Logo
×

বাতায়ন

যোগাযোগ উন্নয়নে রেলপথ

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যোগাযোগ উন্নয়নে রেলপথ

দেশের সামষ্টিক আর্থসামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত হিসাবে যোগাযোগ উন্নয়ন অপরিহার্য। যে কোনো রাষ্ট্রের শিল্পায়ন-নগরায়ণ-সচল গ্রামীণ অর্থনীতির মৌলিক নিয়ামক হচ্ছে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। দেশের সামষ্টিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে পরিকল্পিত বিনিয়োগ-উৎপাদন-পণ্যসামগ্রীর বাজারজাতকরণ। উন্নত বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, জীবনমান উন্নয়ন ও আয়বৈষম্য নিরসনে ভারসাম্যমূলক সমৃদ্ধির মূলে যোগাযোগব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমান সরকারের সময়কালে সাফল্য পাওয়া খাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। ফ্লাইওভার-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-সেতু-কালভার্টসহ নানামুখী ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন দেশে আশাজাগানিয়া উদ্দীপনা তৈরি করেছে।

যোগাযোগের অন্যতম সহজ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ মাধ্যম রেল। রেলপথ সম্প্রসারণ-আধুনিকায়নের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশকে রেলের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। সরকার রেলপথ সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরকরণ, নতুন ও বন্ধ রেলস্টেশন চালু, নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু, কম্পিউটার বেইজড সিগন্যালিং ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ট্রেনের নতুন কোচ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। নতুন নতুন জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এনে অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগ, বিশেষ করে ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক, সার্ক রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে, বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে যোগাযোগব্যবস্থায় নদীপথের গুরুত্ব থাকলেও কালক্রমে রেলপথের আবির্ভাবে পুরো উপমহাদেশে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলপথের সম্প্রসারণ করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা জগতী সেকশনে ৫৩ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের এ অঞ্চলে রেলের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে পরিবেশ, যানজট, নিরাপত্তা, ভূমির পরিমিত ব্যবহার, জ্বালানি সমস্যা এবং বেশি পরিমাণ পণ্য পরিবহণের বিষয় বিবেচনায় দেশে রেলপথকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হয়েছে। ২০১১ সালে রেলপথ বিভাগকে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করা হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় স্বাক্ষরিত সাতটি সমঝোতা স্মারকের অন্যতম ছিল ভারতের রেলওয়ের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে বাংলাদেশ রেলকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতা। বাংলাদেশ জাতীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুসারে, বর্তমানে ৩ হাজার ১০১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনের নেটওয়ার্ক দেশের ৪৩টি জেলাসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে সংযুক্ত করেছে।

৯ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ রেলওয়ে নির্মিত নতুন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ উদ্বোধন করেন। এগুলো হলো-ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থেকে মন্দবাগ ও কুমিল্লার শশীদল থেকে রাজাপুর পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল লাইন, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইনসহ টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ নির্মাণের আওতায় টঙ্গী-জয়দেবপুর ১১ কিলোমিটার ডাবল লাইন এবং পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় রূপপুর রেলস্টেশন-নবনির্মাণ-সংস্কার করা ২৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রেললাইন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রেলের পরিধি বৃদ্ধিকরণে পদ্মা সেতুতে রেলব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত রেলপথ তৈরির জন্য সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশাপাশি পৃথক রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এবং গত ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণের পথে রেলপথ চালু করা হয়েছে। নতুন রেলপথটি ঢাকার গেণ্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর-ফরিদপুর গেছে। আগামী বছর এ রেলপথের বাকি অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বর্তমান সরকার। প্রকল্পের বিশদ বিবরণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সমাপ্ত হওয়ার পর রেল যোগাযোগ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী শহরের প্রবেশপথ আরও বর্ধিত হবে, যা মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলার নতুন এলাকাকে যুক্ত করবে। প্রকল্পটি ঢাকা-যশোর-খুলনাকে ২১২ দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে বিকল্প রেলপথ সংযোগ স্থাপন করবে। এটি বাংলাদেশের ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপ-রুট স্থাপন, জাতীয়-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালবাহী এবং বিজি কনটেইনার ট্রেন পরিষেবা চালু করবে। এ রুটটি কনটেইনার বহনের জন্য গতি ও লোড সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে।

অতিসম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক খুলনা-মোংলা এবং আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগে অনন্য মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিল না বিধায় সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়া ছিল অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ রেলপথ চালু হওয়ায় দ্রুততর সময়ে এবং কম খরচে পণ্য পরিবহণের অবারিত সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটান মোংলা বন্দর ব্যবহারে যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে; সেক্ষেত্রে এ রেলপথ অনেক সহায়ক হবে বলে প্রত্যাশা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, রেলওয়ের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব বৃদ্ধি করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে।

আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের রেলপথের মাধ্যমে নতুন সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের দাবি, এ উদ্যোগের ফলে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। বর্তমানে সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আগরতলা থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোয় রপ্তানি হওয়া পণ্য স্বল্প খরচে রেলপথে নেওয়া সম্ভব হবে। ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ দ্বারা ভারতের অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগেও এসেছে নতুন বিপ্লব। রেলপথটি চালু হওয়ায় কলকাতার সঙ্গে আগরতলার দূরত্ব কমেছে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এ পথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করলেও অল্প সময়ের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে। প্রসঙ্গত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি গণমাধ্যমে বলেছেন, রেলপথে পণ্য পরিবহণ অনেক বেশি নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বিস্তৃত হবে। যখন আমদানি খরচ কম হবে, তখন ভোক্তা পর্যায়ে কম মূল্যে পণ্য পৌঁছাতে পারায় বাণিজ্য বাড়বে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এ রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এতে আমরা খুবই আনন্দিত।’ স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রত্যাশা, এ রেলপথ নির্মিত হওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

এছাড়া উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে নবনির্মিত চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এরই মধ্যে ট্রায়াল রান বা পরীক্ষামূলক চলাচল সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, উদ্বোধনের পর এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে ওই রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। প্রথমবারের মতো রেলপথে যাওয়া যাবে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাছাড়া কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত মহাসড়ক সম্প্রসারিত হলে এর আরও বিস্তৃতি ঘটবে, যা মিয়ানমার হয়ে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সঙ্গে আন্তর্দেশীয় মহাসড়কে সংযুক্ত করবে বাংলাদেশকে। ফলে পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পূর্বে চীন অবধি ঐতিহাসিক ‘সিল্ক রুট’ হবে পুনরুজ্জীবিত। জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বমুখী (লুক ইস্ট) অর্থনৈতিক দুয়ার হবে উন্মুক্ত। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজ হয়ে উঠবে। কৃষি খামার ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রপ্তানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।

যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মেট্রোরেলের যুগে। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ঢাকা মহানগরীর যোগাযোগ ও গণপরিবহণ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। জনঅধ্যুষিত ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও দুঃসহ যানজটে নাকাল মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন এবং তাদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান প্রত্যাশিত।

সংক্ষেপে বলা যায়, এসব যোগাযোগ উন্নয়ন বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে শুধু উঁচুমাত্রায় অধিষ্ঠিত করবে না; নানামুখী বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম