Logo
Logo
×

বাতায়ন

শ্বেতবিপ্লবেও ডিম আমদানি কেন?

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শ্বেতবিপ্লবেও ডিম আমদানি কেন?

দুধ, ডিমকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষিতে শ্বেতবিপ্লবের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বহু বছর আগে। পশুপাখিনির্ভর এ দুটি মূল্যবান খাদ্যপণ্য সেই ঘোষণার পথ ধরে দেশীয় বাজারে বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। ক’বছর আগে দুধের দাম এতটাই কমে গিয়েছিল যে, ডেইরি খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে এর প্রতিবাদও করেছিলেন। বিগত কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ বাজারে ফিডের দাম কম থাকায় ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কৃষি উৎপাদনে নয় বরং উৎপাদিত কৃষিপণ্যে একশ্রেণির অতিমুনাফালোভী করপোরেট ব্যবসায়ীর কুনজর পড়ায় দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

আমাদের দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে কৃষকের তেমন লাভ হয় না। কারণ, উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদেরও তেমন লাভ হয় না। কারণ, তারা উচ্চমূল্যে পাইকারি বাজার থেকে সেগুলো কিনে আনতে বাধ্য হন। তারা খুচরা বাজারে একটু দাম বাড়ালে ক্রেতারা প্রতিবাদ করেন। সেসব কথা সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভোক্তা অধিকার বা সংশ্লিষ্ট সরকারি বাহিনী দ্রুত হাজির হয়ে খুচরা বিক্রেতাকে জরিমানা করেন অথবা জেলে পুরে দেন। অন্যদিকে নাগালের বাইরে থেকে যায় পাইকারি সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী করপোরেটের লোভী ব্যক্তিরা।

কারণ, তারা সবসময় সরকারের অতি কাছের মানুষ সেজে মিলেমিশে থাকেন। করপোরেটের এসব লোভী ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া প্রভাবের মাধ্যমে সুকৌশলে গাছেরটা পেড়ে খাচ্ছেন, আবার তলারটাও কুড়াতে পারঙ্গম। উভয়দিকেই তাদের লাভ। তোয়াজ-তোষণ, তদবির সবকিছুই তাদের করায়ত্তে। তারা সরকারে উচ্চমহলে চলাফেরা করেন, সেমিনারে বসেন, নীতিনির্ধারণে পরামর্শ দেন। চাটুকারিতা করে বক্তৃতা দেন, আবার সুকৌশলে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। এমনকি প্রচলিত দেশীয় যেসব পণ্য আমদানি করা হলে দেশের কৃষক বা উৎপাদনকারীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে যাবে, সেসব পণ্য আমদানি করার জন্য সরকারকে কুপরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্ত করে তোলেন।

দেশে কি ডিমের অভাব পড়েছে? দেশে কি ডিমের মজুত ও সরবরাহ কম? সব বাজারে ডিমভর্তি হাজার হাজার খাঁচা সাজানো থাকে। এমনকি পাড়ায় পাড়ায়, ঘরের পাশের দোকানে সাজানো থাকে ঝুড়িভর্তি ডিম। ডিমের আড়তে কোনো অসঙ্গতি নেই, সরবরাহেও কোনো অভাব নেই। অভাবটা অন্য জায়গায়! জানা গেছে, দেশের বাজারে ডিমের অভাব না থাকা সত্ত্বেও লোভী করপোরেটের কারসাজিতে ডিম আমদানিতে সায় দিয়েছে সরকার। বহুদিন ধরে প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ সুপারিশে সাড়া দেননি। কারণ, এতে দেশীয় ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সব খামারির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এখন ডিম আমদানির ঘোষণায় দেশীয় খামারিরা চরম বিপদের আশঙ্কায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। অথচ, করপোরেটের ব্যবসায়ীরা খুশিতে ডগমগ। কারণ, দেশের জনগণের মাত্র একদিনে প্রয়োজনের চার কোটি ডিম আমদানি করে কার্যত: তারা সরকারের মাধ্যমে দেশের খামারি ও আপামর মানুষকে ভয় দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। বৃহৎ খামার মালিক যারা এসব করপোরেটের সঙ্গে জড়িত, তাদের আরও সহায়তা করে পক্ষান্তরে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করেছেন।

আমদানিকৃত ডিম বার্ডফ্লুযুক্ত কিনা, হাঁসের, মুরগির, কচ্ছপের বা কুমিরের কিনা তা নিয়ে ঘোষণায় স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এমন অবস্থায় বিদেশ থেকে ডিম আমদানির ঘোষণা দেশের মধ্যে আরেকটি ডিম্বকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে অচিরেই। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ডিম ও কৃত্রিম ডিম পরীক্ষা করার কোনো সুব্যবস্থা ঘোষণার মধ্যে আসেনি। ভেজাল ও নিষিদ্ধ পণ্য বিশেষ করে ডিমের ক্ষেত্রে ভেজাল যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সহজ নয়। অন্য যে কোনো শুকনো খাদ্যপণ্যের মতো ডিম আমদানি করা খুব সহজসাধ্য বিষয়ও নয়। গরম আবহাওয়া এবং ভঙ্গুরজাত পণ্যের আমদানিকারকরা ভয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ডিম আমদানি ও বাজারজাত করা কঠিন। এদিকে আমদানিকৃত ডিমের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে গেলে দেশীয় খামারিদের আরও বেশি প্রতারিত করার সুযোগ তৈরি হয়ে যাবে। শুধু এটাই নয়-দেশের সব খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে তাদের কবজায় চলে যাওয়ায় সরকার হা-হুতাশ করে কোনো সুফল আদায় করতে পারছেন না। সরকারের কোনো কথা, হুমকি-ধমকি তাদের কানে প্রবেশ করছে বলে মনে হচ্ছে না।

ভোক্তা অধিকারের উচিত, খুচরা বিক্রেতাদের অযথা হয়রানি না করা। তারা কেউ কেউ পাইকারদের কাছ থেকে ১০০ ডিম কিনে খুচরা বিক্রি করে সারাদিনে মাত্র ৫০ টাকা আয় করেন। তাই ম্যাজিস্ট্রেদের উচিত খুচরা বিক্রেতাদের গ্রেফতার না করা। বরং ধরা উচিত রাঘববোয়ালদের। যারা তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পাশেই চলাফেরা করে। অথবা দামি রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাওয়ার অফার দেয় সারাক্ষণ! আমাদের দেশ শুধু খাদ্যপণ্যই নয়-ইয়াবা বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিস্থিতি, দূরদৃষ্টিহীনতা ও দুর্বলতা লক্ষণীয়।

বিদেশি ডিম আমদানি কি বাজারে অস্থিরতা বা অগ্নিমূল্য সামলানোর আদৌ কোনো ইতিবাচক সমাধান? আমাদের হঠাৎ ডিম আমদানির ঘোষণা কি পেঁয়াজের মতো বিদেশিরা উলটো কর বসিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বিড়ম্বনার ক্ষেত্র তৈরি করবে না? সেজন্য সরকারকে বিচলিত হয়ে হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও বিড়ম্বনা তৈরি থেকে বিরত হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। তা না হলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সামলানো বা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হবে। দেশের একজন মানুষ মানবিক হওয়ার কথা বললে আর বাকিরা অমানবিক হয়ে উলটোপথে চলতে থাকলে কোনো ঘোষণাই কার্যকর হওয়ার উপায় নেই। কারণ, তারা প্রচলিত পরিবেশে চারদিকে হীনতা খুঁজে বেড়াতে তৎপর হতে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়েও, ভেজাল জিনিস সংযুক্ত করতে নির্দেশিত হতে হতে নিজেরাও সেটা অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

সুতরাং, ডিম আমদানির ঘোষণা একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তাযুক্ত পদক্ষেপ বলে মনে হয় না। দীর্ঘমেয়াদে এ পদক্ষেপ দেশীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাজারকে অস্থিতিশীল ও নাজুক করে দিতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে জনগণকে উসকে দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং, ধনী, অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তোয়াজ করার পথ পরিহার করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যা চায়, তাই করার পদক্ষেপ নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি ঢেলে সাজানো উচিত। দেশীয় দুধ, ডিমকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষিতে শ্বেতবিপ্লবের ইতিবাচক প্রবণতা ধরে রাখাই হবে আপাতত উত্তম কাজ।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক

fakrul@ru.ac.bd

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম