বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেট এবং সবশেষে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট কিছুদিনের ব্যবধানে আগুনে পুড়ে ছারখার হলো। এগুলো সবই সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন মার্কেট। এগুলোর কোনোটিই পরিকল্পিত মার্কেট ছিল না। সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস এ মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। মার্কেটগুলো ভেঙে বহুতলবিশিষ্ট ও পরিকল্পিত মার্কেট করার সিদ্ধান্ত ছিল সিটি করপোরেশনের। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি কোনোটিরই। সিটি করপোরেশন এগিয়ে আসেনি, মার্কেটের দোকানিরাও সহযোগিতা করেনি। তাই শুধু মার্কেটগুলোতে দোকানের মাঝে দোকান, দোকানের সামনে দোকান-এমনি করে করে দোকানের সংখ্যাই বেড়েছে; আর ঝুঁকির পরিমাণ বেড়েছে।
শুরুটা বঙ্গবাজার দিয়ে। ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বঙ্গবাজারে আগুন লেগে যায়। পুড়ে যায় ৫ হাজার দোকান। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট। দেখা দেয় পানির সংকট। সাহায্যে এগিয়ে আসে পুলিশ, সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী। মাত্র দুসপ্তাহ পর ছিল ঈদ। ঈদের বাজার ঘিরে কেবল লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছিল ব্যবসায়ীরা। কিন্তু জমজমাট বেচাকেনার মধ্যে এ অগ্নিকাণ্ডে কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। এরপর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে নববর্ষের শুরুতে ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটে। এখানেও ভোররাতে। ১৫ এপ্রিল ২০২৩-এর ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের ২২০ জন কর্মী কাজ করে আগুন নেভাতে। কিন্তু ততক্ষণে আগুনে পুড়ে সব শেষ। ব্যবসায়ীরা সব হারিয়ে পথে বসে। পর পর দুটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার স্মৃতি ম্লান হওয়ার আগেই ১৮ এপ্রিল ২০২৩ সকাল থেকে রাতের মধ্যে আগুন লাগে উত্তরা বিজিবি মার্কেট, বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণের মার্কেট, নিউমার্কেট এলাকার একটি ট্রান্সফরমার, নারায়ণগঞ্জের ওরিয়ন কারখানা, রংপুর জেলার মতিপ্লাজা মার্কেট এবং বগুড়ার শিবগঞ্জের একটি বস্তার গুদামে। সবশেষ আগুন লাগে ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৫০০ দোকান। আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। যথাযথভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে পুলিশ, সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীও। কিন্তু আগুন নেভাতে ছয় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই ছয় ঘণ্টায় ব্যবসায়ীদের দোকানগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আগুন লাগা সব মার্কেটই ছিল অপরিকল্পিত, বিশেষ করে বঙ্গবাজার এবং মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বহুতলবিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণের তাগিদে সিটি করপোরেশন দোকানিদের মার্কেট ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে কয়েক দফায়। দোকানিরা ওঠেনি, সিটি করপোরেশনও তাদের তুলে দিতে পারেনি। তাই অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো আর ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়নি, পরিকল্পিতভাবে নতুন মার্কেটও করা হয়নি। জানা যায়, দুই সিটি করপোরেশনই বেশ কিছু কাঁচা মার্কেট ভেঙে বহুতল পাকা মার্কেট তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু মার্কেট ছেড়ে দিতে ব্যবসায়ীদের নোটিশ করা হলেই তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে আটকে দিচ্ছে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ। এমন আইনি জটিলতায় থাকা মার্কেটগুলো অব্যবস্থার শিকার হচ্ছে, পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থার অধীনে এগুলো আসতে পারছে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন উভয় কর্তৃপক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ বলে এগুলোকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মার্কেটগুলো সেভাবেই থাকছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; সিটি করপোরেশনের অন্য কোনো উদ্যোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না; সরকারের অন্য কোনো দপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয়ও ভয়াবহ এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে যা ভাগ্যের লিখন, তাই হচ্ছে। একের পর এক মার্কেটগুলো আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন মার্কেটগুলো ভেঙে নতুন করে তৈরি করার ঘোষণা দিলেও বর্তমান ব্যবসায়ীদের অন্যত্র ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দিয়ে মার্কেট ভেঙে ফেলতে চায় কিনা, তেমন ঘোষণা তাদের নেই। নতুন মার্কেটে এ ক্ষতিগ্রস্তরা কতদিনের মধ্যে দোকান পাবে, নতুন দোকানের মূল্য কী হবে-এসব ব্যাপারেও তাদের স্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। আর সে কারণেই দোকান ছাড়ার নোটিশপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের উচ্চ আদালতে গিয়ে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আদেশ পাওয়ার রাস্তা সহজ হচ্ছে। তবে পরপর কয়েকটি মার্কেটে আগুন লাগার পর এবং শত শত ব্যবসায়ীর সর্বস্ব হারানোর পর বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হিসাবে জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ দৃষ্টিলাভের দাবি রাখে। এখানে পক্ষ দুটি-সিটি করপোরেশন মার্কেটগুলোর মালিক, ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী দোকানি। কিন্তু এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে হলেও কনসার্নড পক্ষ আদালত এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আগুনের হাত থেকে মানুষ এবং সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন সিটি করপোরেশনের, ব্যক্তি ব্যবসায়ীর-তেমনি সরকার ও আদালতেরও। জনস্বার্থে সবাইকে এক উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে। যে মানুষগুলোর সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার কাজটি যেমন তার, তেমনি মালিক পক্ষেরও। নোটিশ করলাম, আর আমার দায়িত্ব শেষ! নোটিশ পেয়ে আমি আদালতের ইনজাংশন নিয়েছি, সুতরাং আমি বৈধভাবে আছি-শুধু এটুকু শেষ কথা হতে পারে না এক্ষেত্রে। রাস্তায় বাসড্রাইভার অ্যাক্সিডেন্ট করলে বাসের মালিককেও আসামি করা হয়। কেননা, বাসটির কাগজপত্র, ইঞ্জিন এসব ঠিক আছে কিনা, ড্রাইভার সঠিক ছিল কিনা-এসব দায় থেকে বাস মালিককে রেহাই দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে শ্রমিকের ক্ষতি হলে গার্মেন্টসের মালিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না বলে মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। তাহলে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন মার্কেটে আগুন লাগলে সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে মামলা কেন করা হয় না? তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে? মালিকানাধীন মার্কেটের অব্যবস্থার জন্য তারা কি দায়ী হবে না? ঝুঁকিপূর্ণ বলা হলেও তারা সেখানে মার্কেট করার সুযোগ দেওয়ার জন্য কি দায়ী হবে না? যে ব্যবসায়ী নোটিশ পেয়েছিল মার্কেট ছাড়ার জন্য, মার্কেট না ছেড়ে ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য সেও কি দায়ী হবে না?
শুধু বঙ্গবাজার নয়, নিউ সুপারমার্কেট, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে একের পর এক আগুন লাগছে, আগুনের লেলিহান শিখা বিধ্বংসী হচ্ছে, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ব্যবসায়ীর সর্বস্ব। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না-সাহায্য লাগছে সেনা, নৌ আর বিমানবাহিনীরও। কিন্তু তারপরও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসছে না। প্রয়োজনীয় পানির সংকট হচ্ছে। মার্কেট বন্ধ থাকায় যথাসময়ে ফায়ার সার্ভিসের টিম মার্কেটের ভেতরে যেতে পারছে না, মার্কেটগুলোতে যথেষ্ট নজরদারির কোনো ব্যবস্থাই লক্ষ করা যাচ্ছে না। এসব কারণ আগুন লাগার পরপরই আলোচিত হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু পরের আগুনটি লাগার পর দেখা যাচ্ছে, যে কারণটি আগের আগুন লাগার সময় মুখ্য ছিল, তা পরের বেলায়ও মুখ্যই আছে। এ সচেতনতা কি কাউকেই নাড়া দিতে পারে না, কারও ঘুম ভাঙার কারণ হতে পারে না? সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে অবশ্যই বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন; বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। দায়ী পক্ষদের ছেড়ে না দিয়ে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠান মালিক বলে তাদের সাত খুন মাফ হয়ে যাবে-এ সংস্কৃতি থেকে সরকারের অবশ্যই বেরিয়ে আসা উচিত।
বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের জনপরিসরে যেসব ভাস্কর্য, স্থাপত্য, মার্কেট, অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, পার্ক গড়ে উঠেছে-সেগুলো যাতে প্রকৃত সুন্দর হয়, জননিরাপদ হয় এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্থাপিত হয়, তার জন্য আমাদের কোনো আইন নেই। সামান্য ব্যতিক্রম থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যায়নের প্রকল্পগুলোর মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক চেতনা, নান্দনিকতা, সৌন্দর্যবোধ ও সততার অভাব। এসব প্রকল্পে নেই সংবেদনশীল স্থপতি, পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পকদের কোনো অবদান। তাই অপরিকল্পিত উদ্যোগে সামান্য কারও ভুলের সুযোগেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, পুড়িয়ে দেয় জনসম্পদ। সেই আগুন শুধু পোড়াতে পারে না আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের মন।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.net