শিক্ষার মানের অধোগতির কয়েকটি নমুনা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![শিক্ষার মানের অধোগতির কয়েকটি নমুনা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/09/20/image-719950-1695157758.jpg)
অফিসে কাজের চাপ সামলানোর উপায় খুঁজতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’তে উদ্ধৃত আনাতোল ফ্রাঁস (১৮৪৪-১৯২৪) থেকে চিন্তার সূত্র ধার করে তরুণ সহকর্মীকে বলছিলাম, মাছির বহুসংখ্যক চোখের মতো আমারও যদি বহুসংখ্যক চোখ ও সে অনুপাতে সমানসংখ্যক হাত থাকত, তাহলে কাজ এগিয়ে নেওয়াটা কতই না সহজ হতো। সমাজে সুনাম আছে এরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে এমন বিষয়ে ভালো সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী সহকর্মীকে এবার জিজ্ঞেস করলাম, আনাতোল ফ্রাঁসকে চেনেন কিনা। প্রতিক্রিয়ায় চোখ ছানাবড়া করে অবাক-বিস্ময় নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর একই প্রবন্ধে বার্ট্রান্ড রাসেলের (১৮৭২-১৯৭০) নামও রয়েছে, যিনি অপেক্ষাকৃতভাবে সমকালীন। তাই পরিবেশকে সহজ করার জন্য (সহকর্মীকে) জিজ্ঞেস করলাম, বার্ট্রান্ড রাসেলের নাম শুনেছে কিনা। এ প্রশ্নে তার বিস্ময় আরও গভীর হলো এবং তা দেখে আমারও খানিকটা খটকা লাগল।
বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাম্প্রতিক স্নাতক, শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল কলেজ থেকে সম্প্রতি পাশ করা একজন চিকিৎসায় স্নাতক ও শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীর কাছেও একই প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলাম। একমাত্র মেডিকেলে স্নাতক ছাড়া বাকিদের মধ্যেও সেই একই বিস্ময়, যা আমি আমার সহকর্মীর মধ্যে লক্ষ করেছিলাম। হতাশ হয়ে পরিশেষে একটি খ্যাতিমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষা সহযোগীর (Teaching Assistant) শরণাপন্ন হলাম, যিনি সহসাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু অধিকতর হতাশায় ডুবিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেলের বিষয়ে তিনি প্রতিক্রিয়া দেখালেন এই বলে যে, ‘কে উনি?’
যে অভিজ্ঞতার কথা ওপরে উল্লেখ করা হলো, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের সব শিক্ষার্থীরই এমন দশা, তা হয়তো নয়। নতুনদের মধ্যে এমন বহু মেধাবী এবং উচ্চতর জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা পূর্ববর্তী প্রজন্মের সমশ্রেণির শিক্ষার্থীর তুলনায় অনেক বেশি অগ্রবর্তী। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এটি তো সংখ্যাগরিষ্ঠের সাধারণ অবস্থা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের গড়পড়তা প্রকৃত অবস্থা এরূপ যে, ওই স্নাতকেরা ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল তো দূরের কথা, বাঙালি জগদীশ চন্দ্র বসু, আর সি মজুমদার, সত্যেন বোস, সুভাষ বোস কিংবা জিসি দেবের নামও জানে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের নাম জানলেও তার কর্ম ও অবদান সম্পর্কে ওই তরুণদের তেমন স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হবু শিক্ষকের অবস্থানও একই কাতারে। তো, একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের লেখাপড়ার মান ও জানাশোনার পরিধি যদি এতটাই দুর্বল হয়, তাহলে দেশে শিক্ষার সামগ্রিক মান কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এবং সেই মানের শিক্ষা নিয়েই এখন দেশ চলছে।
দেশে এখন ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, এগুলোর মধ্যে গোটা দশেক বাদে বাকিগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষকের ভালো শিক্ষক হওয়া তো দূরের কথা-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই (সিজিপিএ বোঝানো হচ্ছে না। সিজিপিএ এখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেই পাওয়া যায়, এমনকি কোনো কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও)। শীর্ষস্থানীয় দশ বিশ্ববিদ্যালয়েও মানহীন শিক্ষক নেহায়েত কম নেই। ওই যে বলছিলাম-বার্ট্রান্ড রাসেলের বিষয়ে জবাব দিলেন, ‘কে উনি’-তিনি তো ওই শীর্ষ দশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্ভাব্য এক শিক্ষক। তো, প্রধানত এ মানের শিক্ষদের ওপর ভরসা করেই দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে এবং সেখান থেকে প্রতিবছরই প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে এবং বেরিয়ে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই কাজ পাওয়ার দাবি জানাচ্ছে। এখন বলুন তো, এ মানের শিক্ষকদের পাঠদানের আওতায় থেকে ডিগ্রি অর্জনকারী এ তরুণদের কারা কেন কোন প্রয়োজনে কাজ দেবেন? অথচ নৈতিকভাবে এরা প্রত্যেকেই কাজ পাওয়ার অধিকারী।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন মানহীন শিক্ষকের আধিক্য কেন, কীভাবে তৈরি হলেন তারা এবং এর ফল কী দাঁড়াবে? প্রথম জবাব হচ্ছে, ২০০১ সালের পর থেকে গত ২৩ বছর ধরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রধানতম মানদণ্ড হিসাবে কাজ করেছে মূলত রাজনৈতিক পরিচয়। এ সময়ে কোনোরূপ যোগ্যতার বাছবিচার ছাড়াই যখন যারা সরকারে থেকেছে, তখন তারাই তাদের দলীয় লোকদের অবাধে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগদান করেছেন এবং পদোন্নতিও হয়েছে প্রায় সেভাবেই। এ শিক্ষকদের অধিকাংশেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাও নেই। অথচ তাদের হাতেই এখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ।
দেশে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতিদান যে কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি এবং এতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ধস নামানো হয়েছে, সেসব নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোনোই অবকাশ নেই। বস্তুত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজনীতিকরা একান্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে সম্পূর্ণ বুঝেশুনে ও অত্যন্ত সচেতনভাবেই এসব করেছেন। কিন্তু চরম কষ্ট ও হতাশার বিষয় এই যে, এত বড় জাতিগত ক্ষতি সাধনের পরও এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো অনুতাপ নেই। আর অনুতাপ যে নেই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে, ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আত্মবিনাশী কাজটি করেই শুধু তারা ক্ষান্ত হননি-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, উপাচার্য ও অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্ধ দলীয়করণের মতো কাজগুলোও তারা অবলীলায় করে গেছেন। আর এসব করতে গিয়ে কোথাও এবং কখনোই তাদের কোনোরূপ জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতে তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলেও মনে হয় না।
বার্ট্রান্ড রাসেলের পরিচয়-জিজ্ঞাসার জবাবে ‘কে উনি’ বলে দেখানো প্রতিক্রিয়ার তাৎক্ষণিক দায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর বর্তালেও এ করুণ দশার শুরু আসলে শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই। দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে ওই পর্যায়ে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষকের যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, সেটিই বস্তুত শিক্ষার শক্তিশালী প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে না ওঠার মূল কারণ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের এ দুর্বলতাগুলো যে এভাবে এতটা প্রকট বলে প্রতীয়মান হচ্ছে তার একটি বড় কারণ হলো, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে তাদের কোনোরূপ ধারণা, প্রস্তুতি ও সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও গণ্ডায় গণ্ডায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার সুবাদে সনদপ্রাপ্তির জন্য তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। এক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে দেখাদেখি ও সামাজিক লোকাচারের প্রভাবই অধিক। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উভয়েই সমাজকে দেখাতে চায় যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার অংশীদার ও অধিকারী।
প্রচলিত রেওয়াজের বদান্যতায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই বিভিন্ন শ্রেণি পরীক্ষায় অত্যন্ত উদার হারে নম্বর পেয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রচলিত নিয়মের আওতায় তারা খুব সহজেই টিকে যায়। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার মূল্যায়ন ব্যবস্থার বদৌলতে এরা আবারও উতরে যায়। কিন্তু মৌলিক দুর্বলতা ঠিকই থেকে যায়, যার ফল হচ্ছে ‘কে উনি’ এমন উত্তর প্রদান।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিরাজমান এ দৈন্যদশা এতটাই ব্যাপক ও গভীর ক্ষতপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় একেবারেই অসম্ভব। এখানে তাই শুধু এটুকুই বলব যে, নিছক বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে মানহীন করে তোলা হয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিলে এক্ষেত্রে প্রচারসর্বস্ব গতির পরিবর্তে আরও ধীরগতিই অধিকতর কাম্য। গতির নামে মানহীন এ শিক্ষাব্যবস্থা বস্তুতই শিক্ষার আত্মঘাতী অধঃপতন ছাড়া আর কিছু নয়।
আবু তাহের খান : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত; সাবেক পরিচালক, বিসিক
atkhan56@gmail.com