Logo
Logo
×

বাতায়ন

টেকসই উন্নয়নে ওজোন স্তর রক্ষা করতে হবে

Icon

মো. বেলায়েত হোসেন

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

টেকসই উন্নয়নে ওজোন স্তর রক্ষা করতে হবে

ওজোন স্তরের ক্ষয় এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টি ও করণীয় বিষয়ে জনসম্পৃক্ততার লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ওজোন দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Montreal Protocol: fixing the ozone layer and reducing climate change’, অর্থাৎ ‘মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন করি : ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি’। ওজোন হচ্ছে অক্সিজেনের একটি বহুরূপ। মূলত এর গঠন প্রক্রিয়া হচ্ছে অক্সিজেন অণুর সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মির বিক্রিয়া। বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তর স্ট্রাটোমণ্ডলের নিচের অংশে ওজোন স্তরের অবস্থান, যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে। ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি এবং হেনরি বুইসন এটি আবিষ্কার করেন। ওজোনের ঘনত্ব খুব কম হলেও সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষতিকর অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রায় ৯৯ শতাংশ শোষণ করে নিতে পারে। এ রশ্মির প্রভাবে দুরারোগ্য ক্যানসার, চোখের ছানি পড়া, প্রজনন ক্ষমতার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু হ্রাস, উভয়চর প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়া, উদ্ভিদের ক্লোরোসিস রোগ, উৎপাদনশীলতা হ্রাস, খাদ্যচক্রের ক্ষতিসাধন, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে। ওজোন স্তর অতিবেগুনি রশ্মি শোষণের মাধ্যমে উদ্ভাসিত জীবসমূহকে এমন ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। ওজোন স্তর ১০ শতাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর এ রোগে প্রায় ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তাই ওজোন স্তরকে প্রাকৃতিক সৌরপর্দা বলে।

ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব ২০০ ডবসন এককের চেয়ে কমে গেলে তাকেই ওজোন গর্ত বা গহ্বর বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের মতে, ওজোন স্তরের ক্ষয় মূলত মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে জীবনযাত্রাকে সহজ ও উন্নত করতে প্রথম ১৯৬০ সালে বাণিজ্যিকভাবে শীতলীকরণ কাজে যেমন, রেফ্রিজারেটর, হিমাগার, হেয়ার স্প্রে, এয়ারকন্ডিশন, ফোম শিল্প ইত্যাদিতে হ্যালোজেন (সিএফসি) ব্যবহার করা হয়। এ সিএফসি গ্যাস বায়ুমণ্ডলে প্রবেশকৃত এক-শতাংশ অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি দ্বারা ফ্রি-রেডিক্যাল উৎপন্ন করে, যা ওজোনকে ভেঙে অক্সিজেনে রূপান্তরিত করে। হ্যালোজেন মৌল ক্লোরিন ৫০-১০০ বছর পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে এবং ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে।

মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন উৎস ছাড়াও প্রাকৃতিক ঘটনা যেমন-অগ্নুৎপাত, বজ্রপাত, আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া ইত্যাদি কারণেও ওজোন স্তর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওজোন স্তর ক্ষয়ের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে ১৯৭৮ সালে পরিচালিত চিলির ‘পুনটা এরিনাস’ অভিযানে কুমেরুর আকাশে ধরা পড়ে। প্রতি দশকে স্ট্রাটোমণ্ডলে চার শতাংশ ওজোন স্তরের ক্ষয় হতো বলে ধারণা করা হয়; এটিকে বিজ্ঞানীরা ওজোন ছিদ্র বলে অভিহিত করেন।

মন্ট্রিল প্রটোকল হচ্ছে ওজোন স্তর রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ১৯৮৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর কানাডার মন্ট্রিলে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এ প্রটোকল বা চুক্তি গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশ মন্ট্রিল প্রটোকল এবং সংশোধনীসমূহে অনুস্বাক্ষর করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৮১টি রাষ্ট্র কিগালি সংশোধনীতে অনুস্বাক্ষর করেছে এবং এতে ১৮ প্রকার এইচএফসি (হাইড্রোফ্লোরোকার্বন) নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। এ প্রটোকল অনুযায়ী যেসব ওজোন ডিপ্ল্যান্টিং সাবস্ট্যান্সগুলো ওজোন স্তর ক্ষয় করে, সেই গ্যাসগুলো আর কোনো দেশ আমদানি-রপ্তানি বা ব্যবহার করতে পারবে না। এইচসিএফসিসমূহ (হাইড্রোক্লোরোফ্লোরোকার্বন) গ্রিনহাউজ গ্যাস, যার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় কয়েকশ গুণ বেশি। তাই এইচসিএফসিগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়।

ওজোন স্তর ক্ষয়ে তেজস্ক্রিয় অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলবায়ু। উষ্ণায়ন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় প্রকৃতির দুর্যোগগুলোর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। এটি জলজ জীবন এবং স্থলজ জীবন তথা বাস্তুসংস্থানের জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করেন গবেষকরা। জীববৈচিত্র্যের তারতম্যের কারণে অনেক প্রাণী এবং সমুদ্র তলদেশে থাকা ফাইটোপ্লাংকটনসহ জীবসমূহের বিলুপ্তি তার প্রমাণ।

২০০২ সালে অ্যারোসল সেক্টরে ‘Conversion to CFC free technology for the production of aerosol products at ACI Ltd.’ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকলের কমপ্লায়েন্ট দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত রেফ্রিজারেন্ট প্ল্যান্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৩৮০ ওডিপি টন ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার হ্রাস করা হয়। ওষুধ শিল্পে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০১২ সালের মধ্যে সিএফসি ব্যবহার শতভাগ হ্রাস করা সম্ভব হয়। এইচসিএফসি এবং এইচএফসির পরিবর্তে হাইড্রোকার্বন যেমন R-600a, R-290 হিমায়কের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব এবং ওজোন স্তর ক্ষয় করে না। পরিবেশ অধিদপ্তর ওজোন সেলের মাধ্যমে জাতীয় কুলিং প্ল্যান বাস্তবায়ন করে। মন্ট্রিল প্রটোকল সমন্বয়ের মাধ্যমে এইচসিএফসি ফেজ আউট করার নির্ধারিত সময় ২০৪০ থেকে পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে তা ২০৩০ সালকে সময়সীমা ধরা হয়। এ লক্ষ্যে সরকার ক্ষতিকর দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৪ সংশোধন করে। ১ জানুয়ারি ২০১০ থেকে সিএফসি, কার্বটেট্রাক্লোরাইড ও মিথাইলক্লোরোফরম ফেজ আউট শুরু করা হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর এইচএফসি ফেজ আউট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (এইচপিএমপি) স্টেজ-১ প্রণয়ন করে, যা মাল্টিলেটারেল ফান্ডের ৬৫তম নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন লাভ করে। ২০১২ সালে ওষুধ শিল্প থেকে সিএফসি এবং রেফ্রিজারেটর ফোম তৈরিতে এজেন্ট হিসাবে এইচসিএফসি-১৪১বি এর ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়। ২০১৮ সালে মন্ট্রিল প্রটোকল ফান্ডের ৮১তম নির্বাহী কমিটির সভায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৬৭.৫ শতাংশ কমিয়ে আনার টার্গেট রেখে এইচসিএফসি ফেজ আউট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (এইচপিএমপি) স্টেজ-২ অনুমোদিত হয়, যার মাধ্যমে ১.৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এড়ানো সম্ভব বলে আশা করা হয়। অ্যানাব্লিং অ্যাকটিভিটিজ অব বাংলাদেশ ফর এইচএফসি ফেজ ডাউন (ইউএনইপি-কম্পোনেন্ট) প্রকল্প এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত দ্রব্য শনাক্তকরণসহ মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নে কাজ করে।

২০১৪ সালে ওডিএস (Ozone Deplanting Substance) তথা এইচসিএফসি ব্যবহার বন্ধ করতে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির একটি লাইনে এইচএফসি ১৩৪-এ এর পরিবর্তে হাইড্রোকার্বন R-600a ব্যবহার প্রকল্প নেওয়ায় পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওয়ালটন কর্তৃক উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর কম্প্রেসর ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে, যা বাংলাদেশের ‘ব্র্যান্ডিং’ হিসাবে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেসব কোম্পানি এসব পণ্য আমদানি করত তারা এখন বিকল্প হিসাবে কী ব্যবহার করছে তা কঠোর পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, অর্থায়ন, চুক্তি আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন। স্বস্তি ও আনন্দের বিষয় হচ্ছে, মন্ট্রিল প্রটোকলের আওতায় পৃথিবীব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ৯৯ শতাংশ ব্যবহার প্রায় বন্ধ করা গেছে এবং অবশিষ্ট ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ওজোন স্তরের ক্ষতও সেরে উঠছে। তবে তা খুব ধীরগতিতে। মার্কিন প্রফেসর সুজান সোলেমান ও তার সহকর্মীরা এবং যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী কুমেরু বা এন্টার্কটিকার ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, ২০০০ সালে যে ওজোন গর্তটির আয়তন ভারতের আয়তনের সমান ছিল; সেটি ২০১৫ সালে ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার ছোট হয়ে গেছে। মন্ট্রিল প্রটোকলের আওতায় হ্যালোজেন মৌল যেমন-ক্লোরিন, ব্রোমিন যৌগের ব্যবহার হ্রাসকেই এর অন্যতম কারণ হিসাবে তারা দেখছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০-৬০ সালের দিকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সরকার এযাবৎ ওজোন স্তর রক্ষায় ১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ওজোন সেল এ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন, ওডিএস চোরাচালান বন্ধে মনিটরিং, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করার জোর দাবি জানাচ্ছেন পরিবেশবিদরা। সরকার জাতীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়রোধে বড় চ্যালেঞ্জ কিগালি সংশোধনে এইচএফসির বিকল্প রাসায়নিক বা প্রযুক্তির কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত টেকসই ও সাশ্রয়ী মূল্যের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো মন্ট্রিয়ল প্রটোকল বাস্তবায়নে মাল্টিলেটারাল ফান্ডের ওপর নির্ভরশীল। তাই ওজোন স্তরকে পূর্বাবস্থায় ফিরে পেতে এ ফান্ডকে বিস্তৃত ও সমুন্নত করার বিকল্প নেই।

মো. বেলায়েত হোসেন : সহকারী তথ্য অফিসার, রামগড়, খাগড়াছড়ি

belayethussain42@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম