Logo
Logo
×

বাতায়ন

কঠিন এখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কঠিন এখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা

যদি একটা দেশের জনসংখ্যা কমিয়ে দেখাতে পারেন, তাহলে আপনি এর মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখাতে পারবেন। মাথাপিছু আয় দিয়ে অবশ্য দেশের সব শ্রেণির মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বুঝে ওঠা যায় না। কারণ কোটি টাকার যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে দেশে, তাদের আয়ও এর মধ্যে রয়েছে। আবার যাদের সে অর্থে কোনো সঞ্চয়ই নেই, তাদের আয়ও এর অন্তর্ভুক্ত। ঠাট্টা করে তাই বলা হয়, আমার মাথা আর তোমার আয়– এটা হলো মাথাপিছু আয়! তবু আমরা চাই, মাথাপিছু আয় বাড়ুক। এটা বাড়লে সবাই-ই কিছু না কিছু সুফল পায়। যার অনেক বেশি হারে আয় বাড়ছে, তার তো কেনাকাটাও বেশি। সেটা বাড়লে এতে আবার কিছু কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঘটে অন্যের আয়। অনেক টাকাপয়সার মালিকরা ব্যবসা বা শিল্প গড়ে তুললে তাতে সরাসরিই কিছু কর্মসংস্থান হয়। লোকজন দেশের বাইরে গিয়ে উপার্জন করে পাঠালে সেটাও হয় জাতির আয়ের অংশ। সেটা অফিসিয়াল চ্যানেলে না এলেও। তবে অফিসিয়াল চ্যানেলে এলে ভালো। তাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। অনেকদিন ধরে আমরা রিজার্ভ সংকটে আছি। এক্ষেত্রে আয় বাড়িয়ে ব্যয় কমাতে চাইলেও পারছি না। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

রিজার্ভ অবশ্য আমরা বাড়িয়ে দেখাতাম। ডলারে যে অর্থটা এ মুহূর্তে হাতে নেই, সেটাকেও রিজার্ভ হিসাবে দেখাতাম। এটা করেছি দীর্ঘদিন সক্ষমতা বোঝাতে। আমদানির সক্ষমতা। বিদেশি মুদ্রায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা। এখন অবশ্য আইএমএফ-এর শর্তে হাতে থাকা রিজার্ভটাই দেখাতে হচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সেটা তার ঋণের কিস্তি লাভের জন্য দেওয়া শর্তের চেয়েও কম এ মুহূর্তে। সরকার প্রকৃত রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হোক। আইএমএফ-এর ঋণের কিস্তিও পাক। তাতেও কিছু ডলার ঢুকবে দেশে। ডলার সংকটে এর দাম ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। আমদানিতে লাগছে বেশি বেশি অর্থ। তাতে মূল্যস্ফীতিটা কমানো যাচ্ছে না। অন্যান্য দেশ কমাতে পারলেও আমরা যে পারছি না, বরং তা বেড়ে যাচ্ছে-এর একটা কারণ ডলার সহজলভ্য না থাকা। এতে টাকা দাম হারাচ্ছে। মানে ডলারে যারা আয় করে, তাদের টাকাপয়সা বেড়ে যাচ্ছে। হুন্ডি যে কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না, তার বড় কারণ কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। তাতে বেশি টাকা পাচ্ছে প্রবাসীদের পরিবার। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক ভূমিকা নেই, তা কিন্তু নয়। গ্রামের চালচিত্র বদলে যাওয়ায় হুন্ডিতে আসা অর্থেরও বিরাট ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি এক সহযোগী দৈনিকে ড. মইনুল ইসলামের ভালো একটা নিবন্ধ বেরিয়েছে।

এখন কথা হলো, যেসব অঞ্চলে প্রবাসী আয় বেশি, সেখানে জিনিসপত্রের দামও বেশি। মূল্যস্ফীতি বেশি সেখানে। সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির যে তথ্য মিলেছে, তাতে এটা ১০ স্পর্শ করতে চলেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়েও বিতর্ক আছে। এটা সরকার কমিয়ে দেখাতে চায় বলে অভিযোগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগব্যয় হিসাব করে আলাদা মূল্যস্ফীতি দেখানোও জরুরি বলে অনেকের দাবি। সেটা করা হলে তাদের জন্য আলাদাভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার পথ সুগম হবে বলে মনে করা হয়। আবার দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেশি। এর একটা কারণ প্রবাসী আয়। আরেকটা কারণ হলো আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া। বন্দর থেকে ছাড়িয়ে এনে এসব পণ্য গ্রাম পর্যন্ত পাঠাতে পরিবহণ ব্যয় লাগছে বেশি। জ্বালানির দামের কারণে পরিবহণ ব্যয় তো বেড়েছে এবং এটা সবরকম জিনিসপত্রের দামের বৃদ্ধিতে রাখছে বড় ভূমিকা।

এ অবস্থায় গ্রামে যাদের আয় কম, তাদের জীবনমান খারাপ। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর উন্নতি হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতে কাজের সুযোগ ও আয় বাড়ছে। ধান কাটার সময় অনেক অঞ্চলে সহজে মজুর পাওয়া যায় না। তখন দেশজুড়ে তাদের সচলতা বেড়ে যায়। ধান কাটাসহ কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে সে কারণেই। হালচাষ বলতে গেলে উঠেই গেছে। গরু এখন পালা হয় দুধ আর মাংসের জন্য। অনেকে কুরবানির হাটে তোলার জন্যও গরু-ছাগল পোষে। গরু-ছাগলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি বলে খবর হয়। তবে এ হলো একটা দিক। আরেক দিকে আছে ব্যর্থতা। গরু-ছাগল যেভাবে পালন করছি, তাতে খরচ পড়ে যাচ্ছে বেশি। এতে মাংসের দাম কমানো যাচ্ছে না। গোমাংসের দাম এমন জায়গায় উঠেছে যে, এটা সম্ভবত রেকর্ড করেছে বিশ্বে। সাম্প্রতিককালে গোমাংস আমদানি করে এর বাজার শান্ত করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমরা সহজে ও কম খরচে হিমায়িত মাংস আনতে পারি। এতে আবার আপত্তি আসছে তাদের দিক থেকে, যারা ইতোমধ্যে গড়ে তুলেছিল বাণিজ্যিক খামার। এদের মধ্যে আছে অনেক শিক্ষিত তরুণ, যারা আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল।

একসময় ভারত থেকে সীমান্তপথে গরু আসত। মিয়ানমার থেকেও কিছু আসত না, তা নয়। অবৈধভাবে এলেও দীর্ঘদিন এসব গরু মাংসের বাজারকে শান্ত রেখেছিল। যে জনগোষ্ঠী এখন ৭৫০-৮০০ টাকা কেজিতে গোমাংস খেতে পারে না, তারাও তখন এটা কমবেশি খেতে পারত। এখন ব্রয়লার মুরগিই তাদের ভরসা। আর চাষের মাছ; যেমন পাঙাশ, তেলাপিয়া। একসময় তারা কিন্তু ইলিশও খেতে পারত। এটা নিয়ে মধ্যবিত্তও এখন হাপিত্যেশ করে। এ অবস্থায় খবর মিলল, ভারত দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ৫ হাজার টন ইলিশ চায়। ইলিশ রপ্তানি সাধারণভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে দেশীয় চাহিদা পূরণের জন্য। মৌসুমে ইলিশের সরবরাহ ভালো থাকলে সার্বিকভাবে মাছের বাজারেও এর একটা প্রভাব থাকে। তবে সেটা থাকবে তখন, যখন দামটা বেশির ভাগের আয়ত্তে থাকবে। বাজারে প্রচুর ইলিশ; আবার দামও বেশি। তাহলে তো এর তেমন প্রভাব পড়বে না। এ অবস্থায় ভারত বা অন্য কোথাও বিপুল পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি করা হলে এটা বাজারে দেবে খারাপ সংকেত। তাতে দাম যাবে আরও বেড়ে।

অভ্যন্তরীণ বাজারকে অস্থির হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সাধারণত কোনো সরকার পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে না। রপ্তানি নিষিদ্ধ না করলেও বিভিন্নভাবে একে নিরুৎসাহিত করে। ভারত যেমন সম্প্রতি চাল রপ্তানি নিরুৎসাহিত করেছে। সেটা বড় খবর হয়েছে বিশ্ববাজারে। কারণ ভারত হলো সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক। একাই ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে। এমন একটা দেশ রপ্তানি নিরুৎসাহিত করলে তাতে চালের বিশ্ববাজার অশান্ত হবে বৈকি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যেসব খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে আবার কমে এসেছে, তাতে কিন্তু চাল নেই। দুনিয়ার ৩০০ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হলো চাল। এর মধ্যে রয়েছি আমরা। অবশ্য চাল উৎপাদনে আমরা ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয়ে উঠেছি বলে দাবি করা হয়। কিছু চাল প্রতিবছর আমদানিও করে থাকি। সরকার নিজেও আমদানি করে। অনেক সময় দেশের ভেতর থেকে চাল না কিনে বিদেশ থেকে কেনে বলে তাকে অভিযুক্তও করা হয়। ধান-চাল উত্তোলন মৌসুমে সরকারের সংগ্রহ অভিযান সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ নানা দুর্বলতার কারণে। কতটা চাল সরকারের কেনা উচিত আর থাকা উচিত কতখানি মজুত, তা নিয়েও আছে বিতর্ক। জনসংখ্যা বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও সরকার তার মজুত সেভাবে বাড়াচ্ছে না বলে সমালোচনা রয়েছে।

চাল-গমের মতো দানাদার খাদ্যপণ্যের মোট দেশীয় চাহিদা কেমন, সেটা নিয়েও কি বিতর্ক নেই? এতে হ্রাস-বৃদ্ধিও ঘটে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যেসব ফসল গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে রয়েছে আলু। আলুতেও নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি কালক্রমে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে আলুর দাম গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল কেন? বেসরকারি খাত থেকে বলা হচ্ছে, এবার আলুর উৎপাদন ২০ শতাংশের মতো কম হয়েছে। সে কারণেই নাকি সংকট। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছিল। সে বাজারেও আছে তথ্য নিয়ে বিতর্ক। আমরা নাকি চাহিদার বেশি উৎপাদন করে ফেলেছি পেঁয়াজ। সেটা সত্য হলেও পেঁয়াজ যে সময়ান্তরে শুকিয়ে কমে যায় আর অনেকটাই হয় বিনষ্ট, তার হিসাব আমরা করিনি। সেদিকে দৃষ্টি রেখে সময়মতো আমদানিও করা হয়নি। ভারত থেকে কম দামে এটা আমদানির সুযোগ তো ছিল। সেটা নিয়েছি দেরিতে। অবশ্য দেশের পেঁয়াজ উৎপাদকদের ভালো দাম পাইয়ে দেওয়ার নীতি ছিল সংশ্লিষ্টদের। অবাধে আমদানি করতে দেওয়া হলে তো পণ্যের দাম কমে যায়।

এখন এমন কথাও হয়তো উঠবে যে, বাজার শান্ত করে আনতে আলুও কি আমদানি করতে হবে? অনেক দেশই আলু আমদানি করে। উৎপাদনে সামনের কাতারে থেকেও আলু আমদানি করে রাশিয়া। এখান থেকেও তাদের আলু নেওয়ার কথা। তেমন আলু আমাদের ফলাতেও হবে। মিষ্টি আলু কম ফলাচ্ছি কেন, বোধগম্য নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি উন্নয়নেও এর ভূমিকা থাকতে পারে। তবে কথা হলো, আলুও যদি আমদানি করতে হয়; সঙ্গে গোমাংস-তাতে আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া রিজার্ভের ওপর চাপ কি আরও বাড়বে না? চাল আমদানি জরুরি হলে সেটা সম্পন্ন করা নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গোমাংসের চেয়ে আলুর প্রাপ্যতা বেশি দরকারি। সম্প্রতি জানা গেল, সরকার ১০টি এয়ারবাস কিনবে। আর দ্বিতীয় স্যাটেলাইট। এসবেও লাগবে বিদেশি মুদ্রা। ঋণ করেও কেনা যেতে পারে। সেটা কিন্তু সুদাসলে শোধ করতে হবে জাতিকে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম