Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মরণ

অশান্ত সময়ের একজন শান্ত মানুষ

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অশান্ত সময়ের একজন শান্ত মানুষ

মোহাম্মদ নোমান। ফাইল ছবি

মোহাম্মদ নোমান আমার সহপাঠী মোহাম্মদ মুশতাকের বড় ভাই ছিলেন। দুজন সম্পর্কেই মর্মান্তিক অতীতকাল ব্যবহার করতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে, কেননা দুজনের কেউই আজ নেই। মুশতাক গেছে আগে, মোহাম্মদ নোমান গেলেন পরে। মোহাম্মদ নোমান আমার বড় ভাইয়ের মতোই ছিলেন, অনেকটা মুশতাকের কারণে। অথচ এ কথাটা তখন তাকে বলা হয়নি, যখন তিনি জীবিত ছিলেন। বলার সুযোগ ছিল না। এমনকি মুশতাক এবং আমি খুব কাছাকাছি ছিলাম না, ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরে। মুশতাক চলে গেছে কর্মের এক নিজস্ব জগতে, আমি গেছি অন্যত্র। অথবা বলা যায় রয়ে গেছি সেখানেই, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে মুশতাকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এবং প্রথম পরিচয়েই ঘনিষ্ঠতা।

মুশতাক যে সাংবাদিকতায় যাবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তখনই সে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেছিল একটি পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। ইংরেজি অনার্সে আমরা ক’জন ছিলাম? তেরো-চৌদ্দজন হবে, সবাই ছাত্র, ছাত্রী একজন, সেও অবাঙালি। মুশতাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল একটি ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে। ঢাকা শহর তখনো পুরোপুরি মফস্বলীয়, বইপত্র পাওয়া যেত খুবই কম। সহপাঠী আনোয়ার হোসেন আমাকে ‘এনকাউন্টার’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা দিয়েছিল পড়তে, ইংল্যান্ড থেকে তার এক আত্মীয় পাঠিয়েছিলেন। এনকাউন্টার তখন সবে বের হয়েছে। বইপত্রে আমার উৎসাহ দেখেই হবে, মুশতাক আমাকে একটি বই এনে দিয়েছিল বাসা থেকে। ওয়াল্টার পেটারের ‘অ্যাপ্রিসিয়েশনস’। সে বইয়ের নাম শুনেছিলাম, দেখিনি। বইয়ের গায়ে নাম লেখা ছিল মোহাম্মদ নোমানের। তখনই তাকে জানা আমার, ওই বইয়ের ভেতর দিয়ে। মুশতাকই জানাল, অল্প কথার মধ্য দিয়ে।

নোমান ভাই ইংরেজিতে এমএ পাশ করে গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক হিসাবে। এখন আছেন সরকারি কলেজে। মুশতাকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা জমে গিয়েছিল। ওরা থাকত শান্তিনগরে, আমি থাকতাম আজিমপুরে। শান্তিনগর তখন ফাঁকা, আজিমপুরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কলোনি তৈরি হয়েছে। সেখানে আমরা থাকি। মুশতাকের সঙ্গে শান্তিনগরে গেছি আমি। ওরা আগে থাকত কুমিল্লায়। বাবা সেখানে ওকালতি করতেন। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার স্বার্থে চলে এসেছেন ঢাকায়, বাসা নিয়েছেন শান্তিনগরে। সেকালে পড়ালেখার বিষয়ে মধ্যবিত্তের আগ্রহ ছিল খুব বেশি, মুশতাকদের পরিবারকে মনে হয়েছিল তার মধ্যেও বিশিষ্ট। এ মুশতাকদের সাত ভাইয়ের মধ্যে পাঁচজনের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে পরে। মুশতাক ছিল একইসঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাণবন্ত। ওর ভাইদের ভেতরও ওই দুই গুণ দেখেছি আমি। আমার মনে হয়েছে, এরা কথাও বলে একই সুরে ও স্বরে।

মুশতাক আজ নেই। এখনো খুব খারাপ লাগে তার কথা ভাবলে। নোমান ভাইকে বেদনার এ কথাটি একদিন বলতে চেয়েছিলাম। মুশতাকের মৃত্যুর পর দেখা হয়েছিল নোমান ভাইয়ের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বললাম। কিন্তু সবটা বলা হলো না। আমরা উভয়েই বিষণ্ন হয়ে পড়লাম। ধারণা হলো, অধিক বলা প্রগলভতা হবে। ঠিক ওই রকমই মনে হতো আমার নোমান ভাইয়ের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে ততবারই। নীরব নন, প্রাণবন্ত। কিন্তু প্রগলভ নন। এমন নন যে গম্ভীর, কিন্তু অনেক কথা বলেন, যা বলেন ভেবেচিন্তে। তার সামনে অপ্রয়োজনীয় কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ বাক্যালাপ চলবে না। শ্রেণিকক্ষে তাকে দেখিনি কখনো। অন্যদের কাছে শুনেছি, যা বলতেন খুব গুছিয়ে বলতেন, বুঝিয়ে বলতেন, পরিষ্কার করে। একেবারেই সরল মানুষ ছিলেন তিনি। তার নামের সংক্ষিপ্ততার মতোই স্বল্পবাক, কিন্তু আন্তরিক। খুব কাছে আসেন, কিন্তু আবার একটা দূরত্ব বজায় রাখেন। উচ্চহাস্যের নয়, স্মিত হাসির।

সময়টা বড়ই অস্থির ছিল। রাজনৈতিক ভাঙাগড়া তো চলছিলই, সামাজিক জীবনেও ব্যস্ততাটা নিতান্ত কম ছিল না। এখন যেমন উঁচু উঁচু দালান উঠছে, চলছে নির্মাণের যুগ, তখন তেমন ছিল না, কিন্তু উন্নতির ব্যস্ততা চলছিল ঠিকই। মধ্যবিত্ত উঠছিল, দালান না তুলুক জমি কিনছিল দ্রুতগতিতে। সে অশান্ত সময়ে শান্ত মানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই অনেকে, যারা দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভাবতেন। যাদের জন্য চন্দ্র-সূর্যের ওঠানামা সম্ভব হতো। মোহাম্মদ নোমান এ শান্ত মানুষদেরই একজন ছিলেন। শিক্ষকতায় এসেছিলেন তিনি ব্যর্থ হয়ে কিংবা বাধ্য হয়ে নয়। এসেছিলেন স্বেচ্ছায়। হয়তো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকতেন, কিন্তু সেকালে বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিত না। সেজন্যই সরকারি কলেজে গেলেন। ওইটুকুই। নিশ্চয়তার জন্য, উন্নতির জন্য নয়। উন্নতি তার হয়েছে, কিন্তু তার জন্য অস্থির ছিলেন না তিনি।

সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন, জনশিক্ষা অধিদপ্তরের উচ্চপদ পেয়েছেন, কোষাধ্যক্ষ ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের, কিছু সময়ের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সবটাই এসেছে স্বাভাবিকভাবে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দরুন, ছোটাছুটি-দৌড়াদৌড়ির কারণে নয়। তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছেন। একুশে পদকও পেয়েছেন। উভয় প্রাপ্তি ছিল অত্যন্ত যথার্থ। প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। সে অবস্থানেই আমি দেখেছি তাকে। এসব দায়িত্বে তার দক্ষতা ছিল সংশয়াতীত, কিন্তু অনেককে যেমন মনে হয় সবসময়ই চেয়ারে আছেন, যখন বাসায় এসেছেন তখনো, মোহাম্মদ নোমানকে তেমন কখনো মনে হয়নি, বরং উলটো ধারণা হয়েছে যে, যখন তিনি অফিসে বসে আছেন তখনো তিনি অফিসের নন, তিনি নিজেরই, নিজের পেশায়, শিক্ষকতায়। যেন শিক্ষক হওয়ার জন্যই জন্ম তার। অন্য পেশায় যাননি, যাওয়ার কথাও ছিল না।

শিক্ষকদের মধ্যেও আমলা থাকেন, কারণটা হচ্ছে রাষ্ট্রের চরিত্র, যা নাকি পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক। আমলাতান্ত্রিক শিক্ষকদের দেখে মনে হয় তারা শিক্ষক নন, অফিসার; তাদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার্থী নয়, কর্মচারী। মোহাম্মদ নোমান সেরকমের শিক্ষক ছিলেন না। আদপেই নন। একবার তিনি রাষ্ট্রপতির শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব হয়েছিলেন। দেখে আমার অস্বস্তি লেগেছে। তারও লাগার কথা। অব্যাহতি পেয়ে মুক্ত হয়েছিলেন। তাহলে কি বলব তিনি পুরোনো কালের মানুষ ছিলেন? না, পুরোনো কালের নয়, একেবারে আধুনিক কালের, আধুনিক বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন, দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল আধুনিক। তবু বিশেষ কালের নন, যেন চিরকালের মানুষ তিনি। যথার্থ শিক্ষকদের একজন। নিশ্চয়ই তার জীবনে উদ্বেগ ছিল, না থেকেই পারে না, সবারই থাকে। কিন্তু তা তিনি অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করতে পছন্দ করতেন না। ছিলেন তিনি তাদেরই একজন, যাদের ওপর ভরসা করা যায়, যেমনটা যায় যথার্থ শিক্ষকদের ওপর। অনেক দিক থেকেই তিনি ঈর্ষণীয়। তাকে ভোলো কঠিন।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম