Logo
Logo
×

বাতায়ন

মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

Icon

ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। এদিন বাঙালি জাতি হারিয়েছে তার প্রাণপুরুষকে, দেশ হারিয়েছে তার স্থপতিকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবারের ১৭ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এদিন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। দেশবিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা যথার্থই লিখেছেন, ‘একজন বা একাধিক ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নাই।’ কোনো এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় পণ্ডিত অন্নদাশঙ্কর রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বাঙালি বেঈমান, তারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে-পিতৃহত্যাকারী।’ তাই জাতি যথার্থ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেছে স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী।

বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জাতির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন এবং জাতির পিতার মর্যাদা লাভ করেছেন। বাল্যকালে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত, মেধাবী, বহুগুণের অধিকারী ও সবার মধ্যমণি ‘খোকা’। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। তার আপসহীন বৈশিষ্ট্যের কারণে দীর্ঘসময় তাকে জেলে থাকতে হয়েছে এবং একপর্যায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর সব বন্দোবস্ত প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। উত্তাল জনতা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। একাত্তরের পর তিনি ‘জাতির পিতা’ উপাধিতে অভিষিক্ত হন। তিন দশকের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ। তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তার চিন্তাধারা-জীবন দর্শনেরও উত্তরণ ঘটেছে। শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসাবে; কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা প্রগতিমুখী যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অনুগামী। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন নেতাজি সুভাষ বসুর ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট তিন দল নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে সঙ্গী-সাথি-অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তখন থেকেই তার মাঝে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি একটি গভীর টান লক্ষ করা যায়। একই সঙ্গে লক্ষ করা যায় অসাম্প্রদায়িক বোধের মানবিক উন্মেষ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি তাকে অতিদ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তোলে। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী সময়ে দলটির নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তার দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেন।

বঙ্গবন্ধু পরাধীন স্বদেশের অধিকারবঞ্চিত জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে হৃদয়ে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’। স্বাধীনতার পথে বাঙালির যাত্রার প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে জেগে ওঠা জাতির জন্য ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’-জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার সফল স্থপতি। বাংলাদেশের সার্থক রূপকার। জাতির পিতা শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি, তিনি একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্নও দেখেছিলেন। তিনি বলতেন ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, সোনার মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক ও দেশপ্রেমিক। তাই তিনি আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে ১৯৭২ সালে তিনি সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং এ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং স্বাধীনতার সুফল আসবে না। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, ৮০ শতাংশ কৃষকের দেশে কৃষির উন্নয়নে কৃষিশিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির ওপর বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। এজন্যই তিনি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমাদের খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন ভিক্ষা চাইব।’ দেশে কৃষির সব ভিত্তি, বিশেষ করে নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তার স্বল্পতম শাসনামলেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর মতোই তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কৃষিবান্ধব নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষি উপকরণের মূল্য কমিয়ে উপকরণগুলো কৃষকের কাছে সহজলভ্য করার ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়। সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে বাংলাদেশ এখন খাদ্যসহ কৃষির সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিশ্বে আজ রোল মডেল। এমনকি আমরা এখন সবজি, মাছ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য রপ্তানিও শুরু করেছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুর্ভিক্ষের সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও ইনশাআল্লাহ এদেশের মেহনতি কৃষক ও কৃষিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হবো। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের এ অভাবনীয় সাফল্য আজ বিশ্বের বিস্ময়। আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ আজ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে।

জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে দেশপ্রেমিক জনতার সুদৃঢ় ঐক্য ও মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদই একমাত্র ভরসা। দেশ-বিদেশি কুচক্রীমহলের সব ষড়যন্ত্র ভেদ করে, সব বাধার তিমির বিদীর্ণ করে বাঙালি এগিয়ে যাবে দুনির্বার গতিতে-এটাই আমাদের একান্ত কামনা।

প্রফেসর ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম