কীর্তিমান বাঙালি অমর্ত্য সেনের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে অকৃত্রিম আগ্রহ। কেবল নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে আগ্রহের মাত্রাকে খাটো করে দেখা হবে। অমর্ত্য সেনের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহের একাধিক কারণ রয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ে তার বিশ্বস্বীকৃতি আমাদের গর্বিত করেছে সন্দেহ নেই।
পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্কের বিষয়টি। ঢাকার মানিকগঞ্জে বাপ-ঠাকুরদার ভিটেমাটি; বাল্যকাল ও শৈশব ঢাকার ওয়ারীতে কাটিয়ে শান্তিনিকেতন, তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এরপর তিনি হলেন বিশ্বপথিক।
কেমব্রিজ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে পেশাগত জীবনে অসাধারণ মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে সম্মানিত হন অর্থনীতিতে নোবেলে পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সঙ্গে অমর্ত্য সেনের এই যে মাটির টান, তার উল্লেখ পাই দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ভাষায়। তার মতে, ‘অমর্ত্যরে কাজগুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতীক, যাদের তিনি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সময় সমর্থন দিয়েছিলেন। তার শিক্ষায়তনিক কর্মে অমর্ত্য বাংলাদেশের হৃদয়জাত উদ্বেগের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন। বাংলাদেশের মাটিতে অমর্ত্যরে শিকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত।’
জন্ম থেকে এই যে তার বর্ণিল জীবন, তা তিনি আত্মজীবনী ‘এ মেমওয়ার : হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ডে’ বিবৃত করেছেন প্রাঞ্জলভাবে। বইটির একটি বাংলা অনুবাদও বের করা হয়েছিল, নাম তার জগৎ কুটির। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক প্রফেসর আবদুল বায়েস হুবহু অনুবাদ থেকে কিছুটা ভিন্ন স্বাদে অমর্ত্য সেনকে উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছেন। তার রচিত বইটির নাম ‘অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন’।
প্রকাশক সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা। সরাসরি অনুবাদের বিকল্প ভাবনার কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, “অমর্ত্য সেনের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদের আমার আগ্রহ ছিল, তবে এক্ষেত্রে সমস্যাও ছিল। অনুমতির বিষয় একটা প্রধান অন্তরায় ছিল। তাছাড়া, ভবতোষ দত্ত ও অশোক রুদ্র মিলে অমর্ত্য সেনের লেখা দশটি প্রবন্ধ অনুবাদ করিয়ে ‘জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’ নামে যে বই সম্পাদনা করেছেন, সেখানে অমর্ত্য সেনের লেখা ‘গোড়ার কথা’ যেন আমার অনুবাদ করার উৎসাহে জল ঢেলে দিল।
ওখানে তিনি বলেছেন, ‘একই কথা বিভিন্ন ভাষায় বলে যাওয়ার মধ্যে যতটা সুসাহস আছে, সুবিচার ততটা নাও থাকতে পারে..., যে বাংলার সাহায্য ছাড়া ত্রিশের বেশি গুনতে পারি না, নামতা আওড়াতে পারি না, আচমকা খোঁচা খেলে উষ্মা প্রকাশ করতে পারি না, এমনকি পাজি লোকদের ভালো রকম গালমন্দ অবধি করতে পারি না, সেই বাংলায় অনুবাদ করে দেবেন আমার নিজের লেখা অন্য কোনো ব্যক্তি, সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। মানসিক এ নিষ্পৃহতার সঙ্গে হয়তো জড়িয়ে আছে নিজের লেখার বাচনভঙ্গি বিষয়ে কিছুটা বাৎসল্য, কিছুটা অহমিকা।” সংগত কারণে অধ্যাপক বায়েস অমর্ত্য সেনের জীবনকর্মকে তার আপন ভাষায় উপস্থাপন করার আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়েছেন এবং তা পুরোপুরি সফলতার দাবি রাখতে পারে।
বস্তুগত প্রতিযোগিতার কারণেই হোক, আর পড়াশোনার ক্ষেত্রে আগ্রহের ক্রমউদাসীনতায় হোক, আমরা সবকিছুতেই ‘সময় নেই’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তিন-চারশ পৃষ্ঠার একটি বই হাতে পেলে তা মলাট, বড়জোর ‘সূচি’ পর্যন্ত যেতে পারি। তারপর বইটি কেবলই বুক শেলফের শোভাবর্ধনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাঠক সমাজের এ অপ্রত্যাশিত দিকটি বোধকরি লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি তার গ্রন্থ ‘অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন’কে মাত্র ১৫৭ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এটুকুন আকারে গ্রন্থও পড়ার মতো যাদের হাতে ‘সময় নেই’, তাদের পড়ার সুযোগও অধ্যাপক বায়েস বইটিতে রেখেছেন। তিনি সম্পূর্ণ বইটিকে ২০টি শিরোনামে সম্পন্ন করেছেন, যার প্রতিটি পৃথক পৃথক সময়ে পাঠ করার সুযোগ রয়েছে। একটানা তিন-চার ঘণ্টার প্রয়োজন পড়বে না। অধ্যাপক বায়েস ক্রমাগতভাবে সাজিয়েছেন ‘বাড়ি, বাল্যকাল এবং বিদ্যালয়, ‘বাংলার নদী ও অনুভূতি’, ‘নদী ও নারী এবং অন্যান্য’, ‘দাদু-দিদিমার সাহচর্য ও শিক্ষা’, ‘দেয়ালবিহীন বিদ্যালয়’, ‘কলেজস্ট্রীট, কফি হাউজ এবং কেমব্রিজ’, ‘একটি আগাম লড়াই’, ‘বাইসাইকেল, ‘বন্ধু এবং নিকটজন’, ‘বাম-চিন্তা’, ‘উন্নয়ন মানে স্বাধীনতা তুমি’, ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ’, ‘শেষ দুর্ভিক্ষটা’, ‘লন্ডনের বাড়িওয়ালা’, ‘ইউরোপ সফরের স্মৃতি’, ‘ট্রিনিটির তোরণ এবং ওয়েলকাম মাস্টার’, ‘কেমব্রিজ টু কলকাতা এন্ড ব্যাক’, ‘কার্ল মার্কস থেকে কী নেওয়া যায়’, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’, ‘বাংলা এবং বাংলাদেশের ধারণা’, এবং ‘অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন’। এ স্বল্প পরিসরে সব পর্বের যথাযথ চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে সাধারণ পাঠক সময়কে ভাগ করে একটি একটি করে এপিসোড পড়ে তৃপ্তি লাভ করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ সালে ৩ নভেম্বর। সময়টা ছিল হেমন্তকাল। বাংলার কৃষকের ঘরে ঘরে যখন ফসল কাটা ও নবান্নের আনন্দ, ঠিক সেই সময় শান্তিনিকেতনের সেন পরিবারে আনন্দ বয়ে এনেছিল এক শিশুর জন্ম। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শিশুটির মায়ের কাছে বিরক্তিকর একই ধরনের নাম না রাখার পরামর্শ দিয়ে প্রস্তাব করলেন, ‘অমর্ত্য’ নামটির অর্থ : এমন এক জায়গা থেকে আসা, যেখানে মানুষ মরে না (অনুমেয়রূপে স্বর্গ)। অনেককেই এ নামের সাড়ম্বর অর্থ বোঝাতে হয়েছে, তবে অমর্ত্য সেনের কাছে অমর্ত্যে অধিকতর পছন্দনীয় আক্ষরিক, এবং সম্ভবত অধিকতর ভূতুড়ে অর্থ দাঁড়িয়েছিল ‘অপার্থিব’। অমর্ত্য সেনের বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক এবং পিতামহ সারদা প্রসাদ সেন ছিলেন ঢাকার আদালতের বিচারক। তাদের নিবাস ছিল ওয়ারীতে এবং বাড়ির নাম ছিল ‘জগৎ কুটির’। কিন্তু সেসময়কার রীতি অনুযায়ী প্রথম সন্তানের জন্মের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল মাতুলালয়। অমর্ত্য সেনের নানা বা দাদু ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, তিনি শান্তিনিকেতনের পণ্ডিত। তাই সংগত কারণেই অমর্ত্য সেনের জন্ম হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। পরে এসে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন।
অর্থনীতির মানুষ হলেও নদীর সঙ্গে রয়েছে তার অকৃত্রিম বন্ধন। অধ্যাপক বায়েস লিখেছেন, “তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থটিতে ‘বাংলার নদী’ নামক অধ্যায় শুরু হয়েছে নদীর উৎপত্তি, বিস্তার ও বিশালতার ব্যাখ্যা দিয়ে। বিখ্যাত গঙ্গা নদী বেনারস এবং পাটনাসহ উত্তর ভারতের প্রাচীন শহরগুলো পেরিয়ে যখন বাংলায় প্রবেশ করে, তখন দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বড় অংশ পদ্মা নদী সাবলীল মন্থর গতিতে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে শেষ হয়।”
অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক পাণ্ডিত্য নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় না থাকলেও তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুধীসমাজে এক ধরনের কৌতূহল আছে। অধ্যাপক বায়েস অমর্ত্য সেনের সেই দিকটি নিয়ে আলোকপাত করেছেন ‘বাম-চিন্তা’ শিরোনামে। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পা রাখার সময় অমর্ত্য সেনের মনে ছিল দুর্ভিক্ষের দুঃখময় স্মৃতি। শিশু বয়সে দেখা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অমর্ত্যরে স্মৃতিতে অম্লান সেই দুর্ভিক্ষের সম্পূর্ণভাবে শ্রেণিনির্ভর বৈশিষ্ট্য তাকে বেশি হতবাক করেছিল। অবাক হওয়ার মতো ছিল না যে, সেই সময়ের প্রেসিডেন্সির ছাত্র-কমিউনিটি রাজনৈতিকভাবে খুব সক্রিয় ছিল। অমর্ত্য সেন বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদানের জন্য জোরেশোরে উৎসাহী ছিলেন না, তবে রাজনৈতিক বামদের সহানুভূতির মান এবং সাম্যবাদী প্রতিশ্রুতি তার এবং তার বন্ধুদের অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছিল। কেমব্রিজের উদ্দেশে অমর্ত্য সেন প্রেসিডেন্সি ছাড়লেন ১৯৫৩ সালে। কলকাতার বামঘেঁষা বুদ্ধিজীবীদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্রে কেমব্রিজে প্রথমে প্রবেশ করেই অভ্যর্থনা পেলেন অমর্ত্য সেন। নবাগতদের অভ্যর্থনা জানাতে সোশ্যালিস্ট ক্লাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি ওই ক্লাবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
‘কার্ল মার্কস থেকে কী নেওয়া যায়’ অংশে অধ্যাপক বায়েস লিখেছেন : অমর্ত্য সেনের দৃষ্টি পড়ে মার্কসের বিশিষ্ট কিছু চিন্তারীতির ওপর। মার্কস সবিস্তৃত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন যেগুলোর ওপর তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল-দামের শ্রমতত্ত্ব, উৎপাদনের মাধ্যমে অসম মালিকানা, বহুবিস্তৃত শ্রমিক শোষণ, মুনাফার হারের নিম্নগামিতা ইত্যাদি; কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে তার নিরীক্ষা মনে হয়েছে অস্বাভাবিক প্রারম্ভিক। ‘সর্বহারার (প্রলেতারিয়েত) একনায়কতন্ত্র’ বলা হয়েছে; কিন্তু এদের চাহিদার চরিত্র চিত্রণ ধোঁয়াটে এবং প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এ ধরনের একনায়কতন্ত্রের অধীনে কীভাবে কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে খুব কম বলা হয়েছে।
শেষ পর্বটিই এ গ্রন্থের শিরোনাম, ‘অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন’। অমর্ত্য সেন ভাবেন, তিনি বিশ্ব নাগরিক, পৃথিবীর বহু জায়গায় বাস করেছেন এবং সবখানেই স্বস্তিবোধ করেন। কিন্তু অমর্ত্য সেনের ‘দীর্ঘ হাঁটার’ সাথি (এবং সাক্ষী) রেহমান সোবহান মনে করেন, যেখানেই অমর্ত্য সেনের শেকড় গেড়ে থাকুক না কেন, তার বাড়ি (বায়োলজিক্যাল হোমস) থাকছে ভারত ও বাংলাদেশে। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মিক সম্পর্কের সর্বশেষ উদারণ দেওয়া যায় তার নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা ‘প্রতীচী ট্রাস্ট’। এর মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং লিঙ্গসমতা সম্পর্কিত প্রায়োগিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। এ ট্রাস্ট একটি বাংলাদেশে, অপরটি পশ্চিমবঙ্গে।
এটি অমর্ত্য সেনের জীবনধারা, নীতি-সংস্কৃতিবিষয়ক ও দর্শনভিত্তিক একটি সুলিখিত গ্রন্থ। লেখার ভাষা প্রাঞ্জল। অমর্ত্য সেন সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পেতে এ গ্রন্থ পাঠকদের সাহায্য করবে। আশা করব, বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়