সেদিন দেশের অগ্রযাত্রা থামানো হয়েছিল
মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল গণমানুষের মুক্তি। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এ মুক্তি সর্বাত্মক ও সর্বাঙ্গীণ হওয়াই সমাজ-দেশের জন্য কল্যাণকর। অর্থাৎ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার ন্যায্য মৌলিক অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতি শুরু করেছিলেন প্রাক-সাতচল্লিশে পরাধীন ভারতে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা হিসাবে। রাজনীতিতে হাতেখড়ি অবশ্য আরও আগে স্কুলে থাকা অবস্থায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে।
গণমানুষের সত্যিকারের মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজন হয়। পরাধীন দেশে কোনো নাগরিক সার্বিক মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। কারণ, পরাধীন মানেই আগ্রাসী বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা শাসিত-শোষিত হওয়া। গণমানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন হয় গণতন্ত্র। স্বাধীনতা না পেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয় না। কাজেই প্রথমে স্বাধীনতা ও পরে গণতন্ত্র নিশ্চিত না হলে মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ন্যায্য মৌলিক অধিকার নিয়ে জীবনযাপন করতে পারে না; কিন্তু পরাধীন দেশে সে সুযোগ নেই, সেখানে গণতন্ত্র চর্চার পথ সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ থাকে।
গণমানুষের অধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়েই তিনি রাজনীতিতে অগ্রসর হন এবং ক্রমে তার নেতৃত্বের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশের আয়োজন করছিল, তখনই শুরু হয় গণতন্ত্রকে পায়ের তলায় পিষ্ট করার ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রই প্রলম্বিত হয়ে বাঙালির জীবনে নেমে আসে স্মরণকালের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ-২৫ মার্চের কালরাত। বঙ্গবন্ধু এ ষড়যন্ত্রের বিষয় আঁচ করতে পেরেছিলেন; কিন্তু তিনি তো জীবনে কোনো দিন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথে অগ্রসর হননি। জনগণের রায়ের ওপর পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন বলেই পাকিস্তানের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যে সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র চর্চা করতেন, তার নজির ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যেই রয়েছে।
৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে বন্দি। কিন্তু বন্দি অবস্থায়ও তিনি বাঙালির সঙ্গেই ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে আবার তিনি রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির সামনে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সেই মুক্তির কথাই পুনর্ব্যক্ত করলেন-‘বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ এ জনসভায়ই তিনি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপরেখা কী হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট মত প্রকাশ করে বলেন-‘রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে।’
এ কথাগুলো শুধু তার মুখের কথা নয়, তিনি যা বলতেন, নিজের বিশ্বাস থেকে বলতেন, তিনি যা করতেন, তা বিশ্বাস করতেন বলেই করতেন। ১০ জানুয়ারির এ ভাষণের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের সংবিধানে। ১৯৭২ সালের প্রথম বিজয় দিবসের আগেই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত ও জাতীয় সংসদে উত্থাপনের মাধ্যমে সবার মতামতের ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং এ সংবিধান প্রণীত হয় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা-এ চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে।
বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের ওপর আস্থাশীল ছিলেন আজীবন। গণমানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের নিমিত্তেই তিনি রাজনীতি করতেন। তার মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল, সেখান থেকেই গণতন্ত্র চর্চার মৌলিক ধারণাটি লাভ করেন। অসাম্প্রদায়িক না হলে গণতন্ত্র চর্চায় নির্মোহ হওয়া যায় না। তিনি গণমানুষ বলতে ভূখণ্ডের সব ধর্মের-বর্ণের গোষ্ঠীর মানুষকে বুঝতেন। এ ধারণা থেকেই তিনি সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো গ্রহণ ও ব্যাখ্যা করেছেন। এটি স্বাধীন দেশে এসে হঠাৎ করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, গোটা ২৩ বছর ধরে বাঙালির মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম তিনি করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলেন, সেখানেই তিনি এ ধারণাপুষ্ট হন।
কাজেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিতে যে গণতন্ত্র সংযোজন করবেন, সেটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গতানুগতিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার মতে প্রচলিত গণতন্ত্রের অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় না বরং গণতন্ত্রকে শোষণের অস্ত্র হিসাবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সে কারণেই গণতন্ত্রকে সত্যিকার অর্থে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য সমাজতন্ত্রের মিশেলে একটা নতুন ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এ ধারণা থেকেই তিনি সংবিধানের মৌলিক নীতিতে সমাজতন্ত্র সংযোজন করেন। বঙ্গবন্ধু তার গৃহীত সমাজতন্ত্র সম্পর্কেও বলেন-‘বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে। শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ।’
বঙ্গবন্ধু দেশের সাধারণ মানুষের এ দুরবস্থা নিরসনে ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। তিনি বাকশাল গঠন করেন। বাকশাল সফল হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অব্যাহত গতি রোধ করা সম্ভব ছিল না এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা যে আরও বেড়ে যেত, সে বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই প্রতিবিপ্লবীরা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার অন্য কোনো পথ না পেয়ে বঙ্গবন্ধুর বুকেই গুলি চালিয়ে দিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবিপ্লবীরা সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করে বাকশাল নিয়ে। বাকশালের সমালোচনার আড়ালে তারা পিতৃহত্যার অপরাধ ঢাকতে তৎপর হয়। বাকশালকে বলা হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা; কিন্তু বাকশাল মোটেও একদলীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না। সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন, যাতে সবাই সরকারের অংশ হয়ে থাকে এবং জনগণের প্রতি সবার দায়বদ্ধতা থাকে। বাকশালের গঠন প্রক্রিয়া এবং এর যে কার্যপ্রণালি স্থির করা হয়েছিল, তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারলে এ কথাই প্রতীয়মান হবে যে, বঙ্গবন্ধু যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবতেন, বাকশাল সেই পথেরই একটা অগ্রসর ব্যবস্থা ছিল।
মহাকালের হিসাবে ৫৫ বছরের জীবন অতিক্ষুদ্র। কিন্তু মহাকালের মূল্যায়ন তো শুধু মানুষের নশ্বর জীবনের নিয়তিনির্ভর বয়ঃক্রমের হিসাবে নির্ধারিত হয় না। কালের হিসাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন নাতিদীর্ঘ। মহাপাতকেরা পিতৃহত্যার মতো অপরাধ না করলে এ জীবন আরও প্রলম্বিত হতে পারত। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সেই অপার সম্ভাবনাকে হঠাৎ থমকে দিয়ে তাদের কী উপকার হয়েছিল, তা বোধগম্য নয়; কিন্তু বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চোখের স্বপ্নকে যে তারা অকালে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম : অর্থনীতিবিদ; সাবেক এমডি, অগ্রণী ব্যাংক