Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে পুঁজিবাজারকে রক্ষা করতে হবে

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে পুঁজিবাজারকে রক্ষা করতে হবে

দেশের বর্তমান অবস্থায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের দুরবস্থা দেখার মতো কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এ লেখাটি লেখার দিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকে ৩৬ পয়েন্টেরও বেশি দরপতন ঘটেছে। আবার তার পূর্ব কার্যদিবসেও ৩১ পয়েন্ট দরপতন ঘটেছিল। অর্থাৎ পরপর দুই কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকে ৬৭ পয়েন্ট দরপতন ঘটেছে। তাছাড়া প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণও অনেক কমে গেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হতো, আজ বুধবার সেখানে মাত্র ৩৫১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।

অর্থাৎ মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই প্রতিদিন অর্ধেকেরও কম টাকার শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে শেয়ারের দরপতনও অব্যাহত রয়েছে। ফলে স্বভাবতই বিনিয়োগকারীদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ দুর্দিনের বাজারে তাদের মূলধন খোয়া যাওয়ায় তারা প্রমাদ গুনছেন। পুঁজিবাজারের কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়ে, তাদের কারও কারও ‘রোডশো’ ইত্যাদিতে অনুপ্রাণিত হয়ে পুঁজিবাজারকে যারা ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, তাদের এখন কপালে ভাঁজ পড়ার মতো অবস্থা। এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই তাদের অর্ধেক মূলধন হারিয়ে ফেলেছেন। বাকি অর্ধেকও বেচতে গেলে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।

কারণ, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিয়ে ফ্লোর প্রাইসে আটকে রাখার ফলে ওইসব শেয়ারের মূল্য ফ্লোর প্রাইসের নিচে না নামতে দেওয়ায় বেঁধে দেওয়া মূল্যে কেউ সেসব শেয়ার কিনতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার জোর দাবি উঠলেও ১৯৯৮ বা ২০১০ সালের বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষ তা কানে তুলছেন না। কারণ, আমাদের পুঁজিবাজার পুনরায় কোনো ধস বা মহাধস সহ্য করতে পারবে না। আর সে কারণেই ফ্লোর প্রাইসের নামে ঠেকনি দিয়ে আপাতত বাজারটিকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে; কিন্তু এ ব্যবস্থাটি যে আদৌ কোনো সুব্যবস্থা বা টেকসই পদ্ধতি নয়, সে কথাটিও তো সংশ্লিষ্ট সবারই জানা থাকার কথা।

কারণ, পুঁজিবাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়াই বিধি এবং শাস্ত্রসম্মত। সুতরাং, বাজারটির মুখে বাঁধ দিয়ে আটকে রেখে তাকে গতিহীন করে রাখাটাও তো অন্যায়! যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান মহোদয় ইতোমধ্যে কয়েকবার বলেছেন, ফ্লোর প্রাইস কোনো স্থায়ী পদ্ধতি বা ব্যবস্থা নয়, অচিরেই তা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তার সেসব কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আর এসব কারণেই দেশের পুঁজিবাজারও মুখ থুবড়ে একই স্থানে পড়ে আছে।

বর্তমান অবস্থায় বাজারটিকে এমন এক স্থানে আটকে রাখা হয়েছে, তাতে মাঝখানে কিছু অসৎ ব্যক্তি কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার মূল্য বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছে; আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। এ অবস্থায় এসব দেখেশুনে ইতোমধ্যে অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছেন, ‘ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়ে বাজারটিকে নিজস্ব বা স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়া উচিত; অন্যথায় এভাবে ঠেকনি দিয়ে রাখলে পুঁজিবাজার কোনোদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।

বাজারসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে প্রথম প্রথম সূচক আরও কিছুটা নিম্নগামী হলেও একটা নির্দিষ্ট স্থানে এসে তা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থাৎ সূচক আবার ঊর্ধ্বগামী হবে এবং তখন লেনদেনও অনেক বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এসব বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মতামতের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে রাখায় দেশের পুঁজিবাজার এখন দম আটকে মরণাপন্ন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। প্রায় প্রতিদিনের দরপতন এবং লেনদেনে স্থবিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের বোঝা ভারি হচ্ছে। আর যারা ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকার হাউজের ঋণের টাকায় এ ব্যবসায় নেমেছেন বা ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছেন, তারা চরম দুর্দশায় পতিত হয়েছেন। কারণ, ঋণের সুদ টানতে তাদের অনেকেরই মূলধন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।

শুরুতেই বলা হয়েছে, দেশের বর্তমান অবস্থায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের দুরবস্থা দেখার মতো কেউ নেই। যারা দেশ চালান তারা এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতেই ব্যস্ত। আবার বিরোধী রাজনৈতিক নেতারাও ক্ষমতারোহণের ছক কষতে দিনরাত এক করে দিচ্ছেন। এমনকি সরকারি আমলা-কর্মচারীদের গায়েও এখন রাজনীতির দামাল হাওয়া! সুতরাং, পুঁজিবাজারের দিকে তাকানোর মতো সময় কারও আছে বলে মনে হয় না।

তাই এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মর্জিই এখন একমাত্র ভরসা। তাদের ইচ্ছামতোই যা কিছু হচ্ছে এবং হবে। সামনের কয়েক মাস যদি পুঁজিবাজারের দিকে সরকারের নেক দৃষ্টি না পড়ে, তাহলে এক্ষেত্রে যে আমাদের আরও একটি মহাধস প্রত্যক্ষ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই, সে কথাটি কিন্তু আগেভাগেই এখানে বলে রাখা হলো এবং এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো। কারণ, পুঁজিবাজার হলো একটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সুতরাং, পুঁজিবাজারের ভালো-মন্দকে গুরুত্ব না দিলে তা যে দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক কুফল বয়ে আনবে, সে কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজন।

লেখাটির এ অংশে আমি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। কারণ, দেশের অনেক ভালো কোম্পানি যারা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করে ভালো ব্যবসা করেন, প্রচুর মুনাফা করেন, এমন দুঃসময়ে তাদেরও কিছু করণীয় আছে, তাদেরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমি বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির প্রসঙ্গ টেনে বলতে চাই, এ কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের প্রতিবছর বেশ ভালো নগদ মুনাফা দিলেও হঠাৎ করে তারা ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ইস্যু করে অনুমোদিত মূলধন এবং পরিশোধিত মূলধন সমান করে ফেলে (৫৪০ কোটি টাকা)। ফলে বছরে ৬০০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়া কোম্পানিটির ক্যাশ ডিভিডেন্ডও এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে এবং দরপতন হয়ে শেয়ারটির বাজারমূল্যও চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসায় প্রতিটি শেয়ারমূল্য ৫১৮ টাকা ফ্লোর প্রাইসে তা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।

ফ্লোর প্রাইসে আটকে না রাখলে শেয়ারটির মূল্য ৪০০ টাকায় নেমে আসত। অথচ এ কোম্পানিটি বছরে বছরে মুনাফার অর্থের মাত্র অল্প কিছু অংশ বিনিয়োগকারীদের প্রদান করে বাদবাকি মুনাফার টাকা রিজার্ভ ফান্ডে নিয়ে এসে তাদের রিজার্ভভান্ডার স্ফীত করেছে ফেলেছে। আর তাদের বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫৪০ কোটি টাকা অনুমোদিত এবং একই পরিমাণ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির রিজার্ভভান্ডারে পরিশোধিত মূলধনের প্রায় সাতগুণ অর্থ জমা থাকলেও বর্তমানে এ কোম্পানিটি যে পরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকে, তাতে বিনিয়োগকারীরা তিন শতাংশের বেশি মুনাফা পাচ্ছেন না।

অথচ বর্তমান দুঃসময়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ থেকে জমা করা রিজার্ভ ফান্ড থেকেও কিছু মুনাফা যোগ করে ক্যাশ ডিভিডেন্ড কিছুটা বাড়িয়ে দিলে তাতে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হতেন এবং এভাবে শেয়ারটির দরপতনও হতো না। কিন্তু কে জানে বছরে বছরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ থেকে জমা করা এত বিশাল রিজার্ভের অর্থ দিয়ে কী করা হয় বা হচ্ছে? দুঃসময়ে এসব জমাকৃত অর্থের কিছুটা যদি বিনিয়োগকারীদের না দিয়ে তা কোম্পানির মালিকরাই নিজেদের দখলেই রেখে দেন, সেক্ষেত্রে প্রতিবছরের লভ্যাংশের সম্পূর্ণ প্রাপ্য অংশটুকু তো বিনিয়োগকারীদের বছরে বছরে দিয়ে দেওয়াই ভালো, নাকি? যদিও এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাই আরও ভালো বলতে পারবেন।

যা হোক, পরিশেষে আরও কয়েকটি কোম্পানির রিজার্ভসংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেই লেখাটির উপসংহার টানতে চাই। উল্লেখ্য, এভাবে রেনেটা নামক ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ডেও ২৮৭৬ কোটি টাকা সংরক্ষিত আছে। আর এ কোম্পানিটির অনুমোদিত এবং পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে ২৮৫ কোটি এবং ১১৪ কোটি টাকা। অথচ ২৮৭৬ কোটি টাকা অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের ২৫ গুণেরও বেশি টাকা রিজার্ভে জমা রেখে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের যে পরিমাণ নগদ ডিভিডেন্ড প্রদান করেন, তাতে বিনিয়োগকারীদের মাত্র এক শতাংশ পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশ প্রাপ্তি ঘটে। এখানে প্রশ্ন হলো, তাহলে রিজার্ভ ফান্ডের টাকা কে বা কারা ভোগ করবেন? প্রয়োজনের সময় রিজার্ভ ফান্ড থেকে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা লভ্যাংশ যদি ছাড় করা না হয়, তাহলে সে রিজার্ভ ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের লাভই কী?

সবশেষে লেখাটির উপসংহার টেনে বলতে চাই, কাউকে বা কোনো কোম্পানির প্রতি দোষারোপের জন্য আজকের লেখাটি লেখা হয়নি। বরং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার যাতে টনক নড়ে, তজ্জন্যই কথাগুলো বলা হয়েছে। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনের সময় পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারকে যেন বিব্রত হতে না হয়, বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্য সরকারের টনক নড়াতেও আজকের লেখাটি লিখেছি। সেই সঙ্গে বিএসইসিসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট অন্য সবারই টনক নড়ুক, সেটাও কামনা করছি। আর সবশেষে অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ রইল, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ৫০০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য যে আবেদনটি করেছে, অবিলম্বে তা মঞ্জুর করা হলে বর্তমান অবস্থায় পুঁজিবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়।

কারণ শুনেছি যে, বর্তমানে আইসিবি অতীতের অনেক ঋণের টাকা পরিশোধও করে দিয়েছে। সুতরাং, ঋণ হিসাবে প্রার্থিত তাদের আবেদনটি সুবিবেচনার আশা রাখে বলেই মনে করি। এখানে আরও একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে যাই যে, এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারকে কিন্তু কোনো প্রণোদনা বা সুবিধা দেওয়া হয়নি। সুতরাং, আইসিবির প্রার্থিত ঋণ মঞ্জুর করাকে পুঁজিবাজারকে রক্ষা তথা বিনিয়োগকারীদের বাঁচানোর ছোট্ট একটি পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যেতেই পারে।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম