স্বদেশ ভাবনা
তীব্র খরায় আমন আবাদ চ্যালেঞ্জের মুখে
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের ঋতুচক্রে আষাঢ় ও শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। মিডিয়ার খবরে ও ব্যক্তিগত যোগাযোগমাধ্যমে জানা যায়, বর্ষা মৌসুম সত্ত্বেও এবার তীব্র খরায় দেশের বিভিন্ন জেলায় রোপা আমন চাষ ব্যাহত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, এ বছর জুনে (১৮ জ্যৈষ্ঠ-১৬ আষাঢ়) বৃষ্টির পরিমাণ কম ছিল। জুলাইতেও (১৭ আষাঢ়-১৬ শ্রাবণ) সারা দেশেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল কম। আমন চাষের মৌসুমের বেশিরভাগ সময় পার হলেও পানির সংকটে অনেক জেলায় কৃষক এখনো বীজতলাই তৈরি করতে পারেনি। আর তৈরি বীজতলাগুলো প্রখর রোদে হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। তীব্র রোদে ধান চাষের মাঠগুলো খাঁখাঁ করছে। আমন চাষের সর্বোত্তম সময়ে তীব্র খরায় এবারের আমন ফসলের উৎপাদন হ্রাসের সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এসব নিয়ে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দেশে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমন। শীর্ষ অবস্থানটি বোরোর দখলে। আউশ তৃতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর তথ্য মোতাবেক, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ সময়কালে দেশে চালের মোট উৎপাদন বছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯১ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উপর্যুক্ত সমীক্ষা অনুযায়ী, বিগত ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২ সালে আমন উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার, ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার, ১ কোটি ৫৫ লাখ ২ হাজার, ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৮ হাজার, ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টন। আমনের উৎপাদন দেশে উৎপাদিত মোট চালের কম-বেশি ৪০ শতাংশ। আমন ফসলের আবাদ অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। আমন আবাদ খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বা সাইক্লোনে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। আমরা দেখেছি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে পরপর দুটি প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল। ১ কোটি ৩০ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওই মৌসুমে উৎপাদিত আমনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৯৬ লাখ টনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও উপর্যুপরি বন্যার কারণে আমন উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি ভাষ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের আগস্টে বন্যায় সারা দেশের ৩৭টি জেলায় আমন ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসাবে এ বন্যায় ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। চলমান তীব্র খরায় আমন আবাদ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এরপর সেচের মাধ্যমে বা মৌসুমের শেষদিকের বৃষ্টির পানিতে রোপা আমন যে আগামীতে প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্টের (আইসিআইএমওডি) এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় আবহাওয়া এখন অনেকটাই অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে। এখানে এখন আবহাওয়ার আচরণের সঙ্গে পূর্বাভাসের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এ অঞ্চলে এবার মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ছিল গড়ের তুলনায় কম। কিন্তু তাই বলে এবার বন্যার ঝুঁকিও কমেনি। এদিকে খরার কারণে আমন চাষে সেচের পানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি কৃষক পর্যায়ে চালের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়াবে। সারের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গত ১২ মাসে সরকার দুবার সারের দাম বাড়িয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়ে ২২ টাকা করা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সরকার ডিলার ও কৃষক পর্যায়ে কেজিতে সারের দাম আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে একজন কৃষককে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
এদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দেশের প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদনশীলতা তথা প্রবৃদ্ধির হার কম। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও অন্যান্য রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাদ দিলে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার নেতিবাচক থেকে ১ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ এ সময়কালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, চালের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বার্ষিক হার যখন দশমিক ৮২ শতাংশ, তখন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ২০২২ অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে উৎপাদিত চালে দেশের চাহিদা মিটছে না। বছরের পর বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার এবং ৯ লাখ ৮৭ হাজার টন। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২২-২৩) আমদানিকৃত চালের পরিমাণ সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। মিডিয়ার খবরে জানা যায়, গত অর্থবছরে আমদানিকৃত চালের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে চাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে ৯,৮৮৯ ও ৯,৬৯৫ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩)। দেশের চাহিদা মেটাতে আরও চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে চাল আমদানিতে ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার ক্ষেত্রে ধীরগতির কারণে চাল আমদানি বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় বোরো চাল বাজারে আসার আগে সব শ্রেণির চালের দামে নতুন করে উল্লম্ফন ঘটে। বোরো চাল বাজারে আসার পরও চালের দামে তেমন কোনো নিম্নমুখিতা পরিলক্ষিত হয়নি। দেশে চলতি আমন আবাদ যখন তীব্র খরায় আক্রান্ত, রোপা আমন মৌসুম শেষে বন্যার ঝুঁকিতে, তখন রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, এল নিনোর প্রভাবে শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পণ্যটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠতে পারে। ১২ জুলাই জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থা-খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৩’ প্রতিবেদনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে যখন তীব্র ও মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার গড় হার যথাক্রমে ১১.৩ ও ২৯.৬ শতাংশ, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় তা যথাক্রমে ১৯.৪ ও ৪০.৩ শতাংশ। আর ২০২২ সালে বিশ্বে যখন অপুষ্টির হার ৯.২ শতাংশ, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় তা ১৫.৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসাবে বাংলাদেশে গত ৬ বছরে তীব্র ও মাঝারি ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্য স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৩-এর বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ৫ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৯ লাখ। অর্থাৎ দেশে তীব্র থেকে মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ২০১৬ সালের পর গত ৬ বছরে প্রায় ১৮ লাখ বেড়েছে।
চলতি আমন আবাদের চ্যালেঞ্জসমূহ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবতা বৃদ্ধি এবং শস্যচুক্তি থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়া, জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থার প্রতিবেদন, গড়ের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় কম বৃষ্টিপাতের আভাস ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের যা করা উচিত তা হলো, চলতি অর্থবছরে, বিশেষ করে আগামী বোরো ফসলের ধান-চাল বাজারে আসার আগ পর্যন্ত কী পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি প্রয়োজন হতে পারে, তা নির্ধারণে জরুরিভিত্তিতে জরিপ পরিচালনা এবং জরিপের ফাইন্ডিংসের আলোকে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ এবং বাজেট পুনঃনির্ধারণ করা। একইসঙ্গে তীব্র খরায় জমিতে পানি সেচের মাধ্যমে আমন চারা রোপণে কৃষকের যে অতিরিক্ত ব্যয় হবে, তা পুনর্ভরণে পদক্ষেপ গ্রহণ বিবেচনা করা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com