তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের ‘পারমাণবিক বোমা’!
ড. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীজুড়ে তামাকের বিরুদ্ধে যখন একটি গণসচেতনতা গড়ে উঠছে, ঠিক তখনই তামাক কোম্পানিগুলো আটঘাট বেঁধে নেমেছে কীভাবে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে বিকল্প উপায়ে তামাকের নেশায় বুঁদ করে রাখা যায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেই তাদের তীক্ষ্ণ নজর। তামাকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই তারা বাজারে এনেছে প্রযুক্তিনির্ভর ই-সিগারেট, ভ্যাপ, হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ-গন্ধযুক্ত ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট পাওয়া যায়।
বস্তুত ই-সিগারেট একটি কৃত্রিম সিগারেট, যা আগুন ধরানো ছাড়াই টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। এর মধ্যে রয়েছে নিকোটিন, প্রপাইলিন, গ্লাইকল ও ভেষজ গ্লিসারিন ছাড়াও নানা ধরনের ফ্লেভার। ই-সিগারেট থেকে ধোঁয়া টানার সঙ্গে নিকোটিন বের হয়ে আসে, যা আসক্তিকর। এই নিকোটিন অন্যান্য তামাকের নিকোটিনের মতো ক্যানসার তৈরি করে। ই-সিগারেট যে সম্পূর্ণভাবে দূষণ বা ঝুঁকিমুক্ত তা কোনো বিজ্ঞানীই বলছেন না। ই-সিগারেটের ধোঁয়া থেকে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে আসে তা অন্যান্য স্বাভাবিক তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যেও রয়েছে, তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব আসল সিগারেটের চেয়ে কম নয়। এর বিষাক্ত পদার্থ মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ই-সিগারেট নেশা উদ্দীপক। এ ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহারে নিকোটিন আসক্তি জন্মায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ই-সিগারেট নিরাপদ নয় বলে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের বৈশ্বিক অভিভাবক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। প্রায় সব গবেষণাতেই নেতিবাচক দিকগুলো উঠে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছেন, ই-সিগারেট থেকে নির্গত ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকলস ফুসফুসের কোষগুলোতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, এর হিটিং এলিমেন্ট সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষক্রিয়ার পথ সুগম হয়। এই হিটিং এলিমেন্ট একটি তরল দ্রবণকে (ই-লিকুইড বা জুস) এরোসলে রূপান্তরিত করে। এর ফলে উৎপন্ন যে বাষ্প নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তার মধ্যে বিভিন্ন হেভি মেটাল ও ন্যানো-পার্টিকলসের রূপে বিবিধ কার্সিনোজেনিক পদার্থ থাকে।
এই কার্সিনোজেনিক পদার্থগুলো সরাসরি ফুসফুস, রক্ত প্রবাহ ও শরীরের অন্যান্য কোষেও আক্রমণ করে। ফলে রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাছাড়া ই-সিগারেটের মধ্যে আছে কিছু ক্যানসার উৎপাদনকারী ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যেমন-ফরমাল-ডিহাইড, এসিটেল-ডিহাইড ইত্যাদি। গবেষকরা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ই-সিগারেট কখনোই সাধারণ সিগারেটের বিকল্প স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা হতে পারে না।
জাপানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। ভ্যাপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্ট-অ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারে। যেহেতু এসব ডিভাইসনির্ভর সিগারেটেও নিকোটিন রয়েছে, সেহেতু এর ব্যবহারকারীদের শরীরে উচ্চরক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে, যা হৃদযন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়।
জার্নাল অব অ্যামেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল পদার্থ রক্তনালির কোষগুলোকে অকার্যকর করে, যা থেকে হৃদরোগের সৃষ্টি হয়। ভ্যাপ, ই-সিগারেট ব্যবহারে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৭১ শতাংশ এবং হার্ট-অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫৯ শতাংশ বাড়ে, যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক ই-সিগারেটের নিকোটিন।
ই-সিগারেটে থাকা নিকোটিন শুধু শ্বাসনালির মিউকাসের ক্ষতি করে না, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয় (অ্যামেরিকান জার্নাল অব রেসপিরেটরি অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন)। ভ্যাপিং ব্যবহারকারীদের শরীরে ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা মস্তিষ্কে প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি দিতে থাকে। ফলে ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ক ভ্যাপকে প্রশান্তিদায়ক উপাদান হিসাবে গ্রহণ করে এবং এর থেকে এক ধরনের আসক্তি সৃষ্টি হয়।
ভ্যাপ, ই-সিগারেট বা হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলো প্রযুক্তিনির্ভর। বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক্স পার্টসের মাধ্যমে এগুলো কার্যকারিতা পায়, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ব্যাটারি’। ই-সিগারেটে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী ব্যাটারি, যা দিয়ে তাপ উৎপন্ন করা হয়। এ ব্যাটারি বিস্ফোরণ হয়ে এর ব্যবহারকারীর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এমন ঘটনা ঘটেছে নিকট অতীতে।
২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ই-সিগারেট বিস্ফোরিত হয়ে টলম্যাজ ডি’ইলা নামে ৩৮ বছর বয়সি একজন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে উইলিয়াম ব্রাউন নামে ২৪ বছর বয়সি এক তরুণ মৃত্যুবরণ করেন ভ্যাপ বিস্ফোরিত হয়ে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উইলিয়াম ব্রাউন ই-সিগারেটটি ঠোঁটে নেওয়ামাত্রই এর ভেতরে থাকা ব্যাটারিটি বিস্ফোরিত হয়। ঘটনার সময় গাড়িতে বসেছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের জোর এতটাই ছিল যে গাড়ির ভেতরের ধাতব অংশগুলো টুকরো টুকরো হয়ে তার মুখ, মাথার খুলি ও ঘাড়ে আঘাত করে। এতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধমনি কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এ ছাড়া সহস্রাধিক মানুষ আহত হয়েছেন ই-সিগারেট, ভ্যাপ সেবন করতে গিয়ে। সুতরাং, ফ্যাশন হিসাবে আমাদের দেশে যে তরুণরা পকেটে ই-সিগারেট, ভ্যাপ বহন ও সেবন করছে, তারা যে কোনো মুহূর্তে কঠিন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। আর এতে বিপদগ্রস্ত হতে পারে আশপাশের মানুষও।
বর্তমানে একটি উদ্বেগের নাম ই-সিগারেট। আজকাল কিশোর-তরুণরা ই-সিগারেটকে হালের ফ্যাশন হিসাবে গ্রহণ করছে। সিগারেট কোম্পানিগুলোর ভুয়া প্রচারণার সঙ্গে তরুণদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহারের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো ই-সিগারেটের বাজার বিস্তৃত করছে।
আমেরিকার গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৮-মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে; কারণ এর স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ।
টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের (টিসিআরসি) তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেট বিক্রির দোকানগুলো গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য। এসব ক্ষতিকর দ্রব্যের বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচার করা হচ্ছে। ভ্যাপ, ই-সিগারেট, হিটেট টোব্যাকো বা ইমার্জিং টোব্যাকো, যাই বলুন না কেন, এগুলো আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের ‘পারমাণবিক বোমা’, যা দমন করা জরুরি। কারণ প্রচলিত তামাক এমনিতেই বড় সমস্যা আমাদের জন্য।
তামাকের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৮৭ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে ১৩ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশ পৃথিবীতে শীর্ষ ১০টি তামাক ব্যবহারকারী দেশের অন্যতম। তামাকের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও নতুন মারণাস্ত্র ই-সিগারেট ব্যবসা বৈধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তামাক কোম্পানিগুলো। টার্গেট আমাদের মোট বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবক। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সুস্থ জনগণ।
উল্লেখ্য, দেশে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। বর্তমানে ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। আগামী দিনে সুস্থ জাতি নিশ্চিত করতে হলে তরুণদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া আবশ্যক। তামাক কোম্পানির মুনাফা লাভের লালসা চরিতার্থ করতে তরুণদের বলির পাঁঠা হতে দেওয়া যাবে না। যদি ই-সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও পরোক্ষ ক্ষতি বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে চাপ আরও বাড়বে। এমনিতেই স্বাস্থ্য খাতের ভগ্ন দশা। উপরন্তু, তা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
আমাদের দেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার ভয়াবহ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই এটি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আশার কথা হলো, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেশে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছে ই-সিগারেট নিষিদ্ধের বিধান।
আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বাহরাইন, কম্বোডিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, জর্ডান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের ৪৭টি দেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম বা ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.২-তে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা এ সনদে স্বাক্ষরকৃত রাষ্ট্রগুলোর জন্য অবশ্য পালনীয়।
তামাক কোম্পানির বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় অনেকেই মনে করেন, সাধারণ সিগারেট থেকে ই-সিগারেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম। তাই তারা ই-সিগারেট সেবন করছে বা অনেকেই এতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ই-সিগারেট প্রচলিত সিগারেটের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। সুতরাং, সবার প্রতি অনুরোধ-বিড়ি, সিগারেট, জর্দা-গুল, সাদাপাতা এবং হালের ভ্যাপ, ই-সিগারেট বা হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলো বর্জন করুন। বিশেষ করে আমাদের যুবসমাজকে এগুলো থেকে দূরে রাখা অতীব জরুরি। অবিলম্বে ভ্যাপ, ই-সিগারেট, হিটেট টোব্যাকো বা ইমার্জিং টোব্যাকোর আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
ড. অরূপরতন চৌধুরী : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস); সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়)
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com