Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

অতীত থেকে কেউ শিক্ষা নিচ্ছেন না

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অতীত থেকে কেউ শিক্ষা নিচ্ছেন না

প্রাচীনকালে গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রে বিভক্ত থাকায় সেসব রাষ্ট্রকে ‘পোলিস’ বলা হতো এবং এ ‘পোলিস’ শব্দটিই ইংরেজিতে পলিটিক্স এবং বাংলায় রাজনীতি নাম ধারণ করেছে। আর বর্তমানের রাজনীতি নগররাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, আমরা কেউই এখন রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নই।

রাজনীতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন পরিসরে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে। যেমন এটি কিভাবে ব্যবহার করা হবে বা ব্যবহার করা উচিত এবং কোনটি এ ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী, সংঘাত নাকি সমবায়/সম্প্রীতি, সেসব বিষয়ের ভিন্নতার ওপর রাজনীতির ভালোমন্দ নির্ভর করে। কারণ রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার কোনোটার মধ্যে আছে নিজ নিজ ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক অভিমত সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করা, অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বা দলের সঙ্গে মতবিনিময় করা, মেনিফেস্টো/আইন প্রণয়ন করা ইত্যাদি। তা ছাড়া পরস্পর ব্যক্তি বা দলের প্রতি বল প্রয়োগের চর্চা করাও রাজনীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান কী বা কোথায় তা সহজেই অনুমেয় এবং আমরা যে রাজনীতির নেতিবাচক দিকটির আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি, সে কথাটিও বলাই বাহুল্য। কারণ রাজনীতির নামে দিনরাত আমরা একজন আরেকজনের, এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছি; চরিত্র হনন করে চলেছি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দলের মধ্যে রাজনৈতিক সহিঞ্চুতার লেশমাত্র নেই। পারলে আমরা এক দল আরেক দলের লোকজনকে পিষ্ট করে ফেলতে চাই; অস্তিত্ব বিলোপ করে দিতে চাই। মাঝেমধ্যেই হামলা-মামলা করে সেসব ঘটনা প্রমাণ করি। গ্রেনেড হামলা, বন্দুক হামলা করে আমরা একজন আরেকজনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই।

যার যে ক্ষমতা আছে, তাই দিয়ে এক দল আরেক দলকে শায়েস্তা করতে চাই। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা আপসহীন! নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে এক দল আরেক দলকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিতে যে কোনো প্রকার হীন ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশল অবলম্বন করে থাকি। ফলস্বরূপ দেশের সাধারণ মানুষকে এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাশুল গুনতে হয়। রাজনৈতিক মিছিল, মিটিং, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে রাস্তাঘাট বন্ধ করে খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রুজির পথ পর্যন্ত রুদ্ধ করে দেওয়া হয়! সময়ে সময়ে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় ব্যবহৃত পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ দেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দ তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে বাসে আগুন লাগিয়ে নিরীহ যাত্রীদের পুড়িয়ে মেরে একে অপরের প্রতি দোষ চাপান।

উপরের কথাগুলো এমনি এমনি বা হঠাৎ করে এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কারণ অতীতে ন্যক্কারজনকভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে; রাজনীতির নামে নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ অবস্থায়, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করে ভবিষ্যতে মানুষের ভোগান্তি যেন বাড়ানো না হয় সে বিষয়ে আগাম সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। কারণ বর্তমান সময়েও দেশের মানুষের ‘ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখার মতো অবস্থা’; অতীতের মতো আবারও তারা একই ভয়ে ভীত। এই যে সেদিন দেশের প্রধান দুটি দল এক কিলোমিটার অপেক্ষা কম দূরত্বে জনসমাবেশ করে তাদের শক্তি সামর্থ্যরে প্রমাণ দিল, ভবিষ্যতে তাদের এসব কর্মসূচি অহিংস থাকবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত ইতিহাস তেমনটি বলে না। সুতরাং ভবিষ্যতে যে তারা অহিংস কর্মসূচি পালন করবেন, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ ক্ষমতায় যেতে তাদের সবাই মরিয়া; ক্ষমতাই তাদের একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান!

এ অবস্থায়, আর মাত্র পাঁচ-ছয় মাস সময়ের মধ্যেই দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের মানুষের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ততটাই বেড়ে চলেছে। কারণ নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে কোনো গোষ্ঠী বা দলই হাত গুটিয়ে বসে নেই। আবার এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের তৎপরতাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। অতীতে কখনো আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বা নির্বাচনের সময়ে এত বেশি বৈদেশিক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে বিদেশি শক্তিগুলোও এখন সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমে পড়েছে; যার নেতৃত্বে আছে খোদ আমেরিকা।

আর আমেরিকা যে অঘটনঘটনপটীয়সী একটি শক্তি এ কথা আমাদের সবারই জানা আছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে তারা অনেক অশান্তির বীজ রোপণ করেছে। সে অবস্থায় বর্তমানে আমাদের দেশে আমেরিকার ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সে দেশের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা একের পর এক আমাদের দেশে এসে নির্বাচনি প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছেন! আর এ অবস্থার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।

অতীতে আমাদের নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলস্বরূপ, নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ জনমনেও অনেক কথা উঠেছে; তাদের অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে খয়ের খাঁ উপাধিতে ভূষিত করে বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না বলে জানিয়েছেন। তা ছাড়া তারা এ সরকারের অধীনেও নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন না। আর এসব কিছু বিবেচনায় আনলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ আরও ঘোলাটে আকার ধারণ করতে চলেছে এবং সে ক্ষেত্রে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্যও অনেকে ওঁত পেতে বসে আছেন। দেশ-বিদেশে বসে অনেকেই এ সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে বিদেশি শক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দিনরাত তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে আবারও দুর্যোগের কালোমেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে দেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আর এজন্য সম্পূর্ণভাবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দই যে দায়ী, সে কথাটি বলাই বাহুল্য। কারণ প্রতিবারই নির্বাচনের সময় তারা ধান্দাবাজ এবং স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে নির্বাচনি টিকিট ধরিয়ে দেয়ায় পরবর্তী নির্বাচনে সেসব প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না বলে সংশ্লিষ্ট দলটির জন্য আবার ক্ষমতায় আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, ক্ষমতায় থাকা দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নামে; যার ফলে ক্ষমতায় ফিরতে বিকল্প রাস্তা অবলম্বন করতে হয়।

কখনো আবার নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান পদে নিজেদের পছন্দের লোক আনতে বিচারপতিদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে; আবার কখনো নির্বাচন কমিশনে নিজেদের লোক বসাতে হয়। আর, তাদের দলের রাজনৈতিক হাইকমান্ড যাদের হাতে নির্বাচনি টিকিট ধরিয়ে দেন, আবার নির্বাচিত হয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের সফলতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কারণেই এসব করা হয়। অথচ বড় দুটি রাজনৈতিক দলেই প্রচুর ভালো মানুষ, নির্লোভ মানুষ, নিঃস্বার্থ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, জনদরদি মানুষ, নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে জনকল্যাণে নিয়োজিত মানুষ থাকা সত্ত্বেও দলীয় হাইকমান্ড এসব মানুষকে চোখে দেখেন না। নির্বাচনের সময় হুন্ডা-গুন্ডা দেখে প্রার্থী বাছাই করা হয়। যার ফলে দলের জনপ্রিয়তা টেকসই হয় না। পরের নির্বাচনেই গণেশ উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয় বিধায় নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে জনগণের ওপর আস্থা না রেখে বিকল্প রাস্তায় পা বাড়াতে হয়।

লেখাটি আর দীর্ঘায়িত না করে উপসংহার টেনে বলতে চাই, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা এসব বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান লাভ করেছি। একইভাবে সে সময়েও একটি বড় রাজনৈতিক দলকে জনপ্রিয়তা হারিয়ে নির্বাচনি ময়দানে ধরাশায়ী হতে দেখেছি। জানি না সেসব ঘটনা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো অভিজ্ঞতা অর্জন করে লাভবান হয়েছেন কিনা। এখনো সময় আছে, নিজ নিজ দল থেকে সাবধানতার সঙ্গে ভালো মানুষ বাছাই করে তাদের হাতে নির্বাচনি টিকিট ধরিরে দিলেই কেবল দলের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে বা দলের জনপ্রিয়তা টেকসই হবে।

অন্যথায় বেছে বেছে হুন্ডা-গুন্ডাওয়ালা প্রার্থীর হাতে টিকিট ধরিয়ে দিলে সেসব গোলমাল আলীগং গায়ের জোরে আপাতত দলের জন্য কিছু সিট কেড়ে আনলেও ভবিষ্যতে কিন্তু তাদের কারণেই দলের ভরাডুবি হবে। অতএব সাধু সাবধান! আর নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশেও বেশি কথা না বলে শুধু একটি কথাই বলব, দেশ ও জাতির কাছে দায়বদ্ধ থাকুন; ভোটারদের জন্যও আপনাদের অনেক কিছু করার আছে, তাদের ভোট যাতে কোনো ভোটশিকারি, ভোটচোর বা ভোটডাকাত হরণ করতে না পারে; তজ্জন্য ভোটারদের স্বশিক্ষিত করার একটি কর্মসূচি গ্রহণ করুন। কারণ আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এ দেশের বেশির ভাগ ভোটারই নিরীহ, সহজ-সরল এবং দরিদ্র। ফলে এ শ্রেণির ভোটারদের ভোটও কিন্তু ধোঁকা দিয়ে কেড়ে নেওয়া, কিনে নেওয়া সম্ভব। সুতরাং এসব ভোটারকে সচেতন করতে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতেই পারে।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম