জনদুর্ভোগ আর অরাজকতার সাতকাহন
মনজু আরা বেগম
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা প্রতিনিয়ত এমন এক বিশৃঙ্খল ও অরাজকতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। কোনটা দিয়ে শুরু করব আর কোথায় গিয়ে শেষ করব বুঝে উঠতে পারি না। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাসহ এমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই, যেখানে অরাজকতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। তার ওপর এ অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা এবং দুর্ভোগ জীবনকে প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে।
নিয়ন্ত্রণে নেই মূল্যস্ফীতি। বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও জীবন ধারণের জন্য সর্বনিম্ন উপকরণটুকু যদি মেটাতে হিমশিম খেতে হয়, তাহলে এ বেঁচে থাকার অর্থ কী? খাওয়া পড়ার বাইরেও জীবন চলার জন্য নাগরিক সুবিধাসহ আরও অনেক কিছু রয়েছে, যা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বললে বোধহয় ভুল হবে না। প্রতি মুহূর্তে ভোগ করছি অন্তহীন দুর্ভোগ। ব্যাংক, বিমা, হাসপাতাল, গণপরিবহণ, অফিস-আদালতসহ এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হয়রানি বা জনদুর্ভোগের শিকার হতে হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্নীতি, নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের পাশাপাশি জবাবদিহিতার অভাব। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলে সাধারণ মানুষকে এতটা দুর্ভোগের শিকার হতে হতো না।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি না থাকায়, বাজেট ঘাটতি পড়ায় প্রতি মুহূর্তে অধিকাংশ পরিবারে অশান্তি বিরাজ করছে। একটু শান্তির অন্বেষায় ঘরের বাইরে গিয়েও নিস্তার নেই। শুরু হলো রিকশাওয়ালার সঙ্গে খিটিমিটি। ২০ টাকার ভাড়া হাঁকছে ৪০/৫০ টাকা। নির্ধারিত কোনো মূল্য কোথাও নেই। যে যা পারছে আদায় করে নিচ্ছে। সরকারি মূল্য তালিকা অকার্যকর। রয়েছে রাস্তাঘাটের চরম দুর্গতি। হাউজিংগুলোতে হাউজিং কমিটি মাসে মাসে চাঁদা নেয়, কিন্তু এ চাঁদার টাকা দিয়ে কোথায় কী করে জানি না। এক কথায় বলতে গেলে, চাঁদার বিনিময়ে আমরা কোনো সেবা পাই না।
জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য রয়েছেন ওয়ার্ড কমিশনার, কাউন্সিলর, মেয়র, এমপি; কিন্তু আমরা তাদের কাছে কোনো সেবা পাই না বললে বোধকরি ভুল হবে না। আমরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি, আয়কর দেই, কিন্তু নাগরিক সুবিধা তেমনভাবে পাই না। অভিযোগ করলে ফল তো হয়ই না, উলটো হয়রানিতে পড়তে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, করোনা মহামারি শেষ হতে না হতে শুরু হয়েছে ডেঙ্গু মহামারি। সিটি করপোরেশনগুলো জনদুর্ভোগের বিষয়গুলো মাথায় রেখে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে অবস্থা এমন পর্যায়ে আসত না।
এ ছাড়াও সিটি করপোরেশন থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশা নিধনের যে কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত দুর্বল এবং মানসম্পন্ন নয়। শুধু কি তাই, পাড়ায়, মহল্লায়, কিশোর গ্যাং মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এদের অত্যাচারে নাগরিক জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। গভীর রাত পর্যন্ত এরা চায়ের দোকানে, মহল্লায়, অলিগলিতে নেশায় বুঁদ হয়ে হৈহুল্লোড় করে। এদের ভয়ে রাতে এবং ভোরবেলায় চলাফেরা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাপারে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং থানাগুলো যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখানেও আসে জবাবদিহিতার প্রশ্ন।
জবাবদিহিতা যে কোথাও নেই তার দু/একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১২ জুন জরুরি প্রয়োজনে রংপুরে যাওয়ার উদ্দেশে সময় ও কষ্ট বাঁচানোর জন্য এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিকাল ৩টায় ইউএস বাংলার একটা টিকিট কাটি। যানজটে নাকাল হওয়ার ভয়ে বাসা থেকে দুপুর ১২টায় বের হই। বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারি ৩টার ফ্লাইট ৪টা ৩০ মিনিটে ছাড়বে। সময়, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট কোনোটাই লাঘব হলো না। সড়কপথে গেলে এর অর্ধেকেরও কম টাকায় যেতে পারতাম। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে রওয়ানা হলাম তা আর বাস্তবায়িত হলো না।
একইভাবে ১৭ জুন ইউএস বাংলার ৪টা ৩০ মিনিটের ফিরতি ফ্লাইটে আসার জন্য রংপুর থেকে দুপুর ১টায় ইউএস বাংলার মাইক্রোবাসে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেই। রংপুর থেকে সৈয়দপুর যেতে ঘণ্টাখানেকের মতো সময় লাগলেও দুপুর ১টার পরে তাদের আর কোনো ট্রান্সপোর্ট না থাকায় অগত্যা বিমানবন্দরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু এ অপেক্ষার যেন আর শেষ হয় না। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটের ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষার অবসান ঘটল যাত্রীদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে রাত ৯টায়। বিমানবন্দর থেকে ঢাকার বাসায় এসে পৌঁছাই রাত ১২টায়। অর্থাৎ মোট সময়ক্ষেপণ হলো ১২ ঘণ্টা।
ফ্লাইট দেরির যে কারণ তারা দেখিয়েছে, তা যাত্রীদের কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়নি। কারণ, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে অন্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট যদি যেতে পারে, তাহলে তারা পারবে না কেন? আসল ঘটনা হলো সম্ভবত যাত্রী সংখ্যা কম হওয়ার কারণে ২/৩টা ফ্লাইটের যাত্রীকে একসঙ্গে নেওয়ার জন্য তারা যাত্রীদের হয়রানি করেছে। ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ার কারণে অনেক যাত্রীকে কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে না পারাসহ অনেক ভোগান্তিতে বা দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এক ভদ্রলোক তার এক স্বজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। অনেক কষ্টে ট্রলি জোগাড় করে রোগীকে ট্রলিতে তোলামাত্র হাসপাতালের এক মহিলা কর্মী ছুটে এসে মুমূর্ষু রোগীটাকে ট্রলি থেকে নামাতে উদ্যত হতেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠেন। নামানোর কারণ জানতে চাইলে সে ৫০ টাকা দাবি করে। কারণ, সব রোগীকেই টাকার বিনিময়ে ট্রলিতে করে হাসপাতালের অভ্যন্তরে নিতে হয়। এটাই হাসপাতালের নিয়মে দাঁড়িয়েছে। সেই মহিলা কর্মীকে (সম্ভবত আয়া) অনেক অনুরোধ করার পরও ট্রলি নিয়ে টানাটানি করাতে ভদ্রলোক চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও হাসপাতালের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। ওই মহিলা কর্মীর উদ্ধত আচরণ, হম্বিতম্বি দেখে মনে হয়নি এটি কোনো সরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠান। এদের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে।
জেলা শহরের হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরও করুণ। গত ১৪ মে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গাইবান্ধা জেলা শহরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের করুণ চিত্র। মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে বের হয় না লাশ। সর্বত্রই দালালের দৌরাত্ম্যে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ। রোগীদের দেওয়া হয় নিম্নমানের খাবার। বেকায়দায় না পড়লে কোনো রোগী এসব নিম্নমানের অখাদ্য খাবার খায় না। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ জনপদের ২৭ লাখ অধিবাসী।
হাসপাতালের অনিয়ম আর দুর্নীতি প্রতিরোধে গাইবান্ধা জেলার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে মানববন্ধন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, কাজের কাজ কিছুই হয় না; কারণ একটাই। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। একই অবস্থা রংপুরেও। বিভাগীয় শহর হলেও এ হাসপাতালের অবস্থাও করুণ। টাকা না দিলে রোগীকে ট্রলিতে উঠানো হয় না। এখানে রেট করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের হয়রানি, দুর্ভোগের কথা পত্রিকার পাতায় প্রতিনিয়ত আসছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে এসব বিষয় জানা থাকার পরও শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে আমরা তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখি না। যার কারণে এ শ্রেণিটার দৌরাত্ম্য বহুগুণে বেড়ে গেছে। পাসপোর্ট অফিসের দালাল, দৌরাত্ম্য আর দুর্নীতির কথা ওপেন সিক্রেট। আসলে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। এ অবক্ষয় রোধ ও জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য ভালো কাজের পুরস্কার ও খারাপ কাজের তিরস্কার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com