Logo
Logo
×

বাতায়ন

ইউজিসির অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

Icon

সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইউজিসির অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

১৯৯০ বা ২০০০ সালের দিকেও বিসিএস পররাষ্ট্র, প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডার ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছেন, এমন অনেক উদাহরণ ছিল। আমার পরিচিত অনেক শিক্ষকই আছেন যারা ক্যাডার সার্ভিস ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন। আজকের পরিস্থিতিতে হয়তো বা সেসব শিক্ষকের খুব আফসোস হওয়ারই কথা। আফসোস হবেই না বা কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, শিক্ষকরা তাদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। সেজন্যই তার সময়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন, হয়তোবা এসব দিক চিন্তা করে এ পেশায় একসময় দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা আসতেন। আর এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, যেখানে কিনা ডিসিকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে বাধ্য করা হয়! তাই এখন শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন; কিন্তু গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহ খুব বেশি একটা নেই। ইদানীং উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন কিছুটা বাড়লেও অনেকেই বিদেশ থেকে আর ফেরেন না, এমনকি আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফেরেন না। বর্তমানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ দৈন্যদশা চলছে। এছাড়া শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট, ল্যাবের অভাব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসহ নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এসবের পেছনে অবশ্য আমাদের শিক্ষক সমাজও কোনো অংশে কম দায়ী নয়।

এতক্ষণ এ কথাগুলো বলার একটা উদ্দেশ্য আছে। সম্প্রতি একটি খবরে সবার দৃষ্টি পড়বে : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং সেটি ১ জুলাই থেকে মেনে নিতে বলেছে। এর আগেও ইউজিসির অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, যা এখনো চলছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সেই নীতিমালা মেনে নেয়নি। এর মধ্যে এখন আবার অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইউজিসি বলছে, এ নীতিমালার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা ও ভালো শিক্ষার্থী তৈরিতে সহায়তা করবে।

আর্থিক অভিন্ন নীতিমালাটি আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে বড় একটা অংশজুড়ে শিক্ষকদের পারিতোষিক নিয়ে আলোচনা, অর্থাৎ শিক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন, অ্যাসাইনমেন্ট ভাইবা নেওয়াসহ বিভিন্ন খাতে কত টাকা পাবে, তা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার পর থেকে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ খাতে অনিয়ম হয়েছে? কোনো শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই কি তার পারিতোষিক গ্রহণ করে থাকেন? অথবা কোনো শিক্ষক কি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী প্রাপ্য পারিতোষিকের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি পারিতোষিক গ্রহণ করেছেন? এমন অভিযোগ ইউজিসির কাছে আছে কি না, তা আমার জানা নেই। শিক্ষকরা আগে যে পারিতোষিক পেতেন, তা কমিয়ে দিয়ে একটি নীতিমালা চাপিয়ে দিয়ে কীভাবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে ইউজিসি? যেখানে আজ পর্যন্ত আমার জানামতে কোনো অনিয়মই হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যাদের জন্য এ নীতিমালা, তাদের বাদ রেখেই এটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে রাখা হয়নি সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন’-এর কোনো নেতা বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির কোনো প্রতিনিধিকেও।

এবার অন্য কিছু কথায় আসি। অনেক শিক্ষক মনে করেন, আমলারা সব সময় শিক্ষকদের দেখে ঈর্ষান্বিত হন। অবশ্য তা মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। অভিন্ন নিয়োগ নীতি বা আর্থিক নীতি বা অন্য কোনো নীতির কথা-যাই বলি বা কেন-এসবকিছুই হয় আমলাদের হাতের ইশারায় এবং এসব নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বড় দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বর্তমানে ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৯০ শতাংশের ওপর শিক্ষক হতাশায় ভোগেন। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন শিক্ষক এ পেশা ছেড়ে বিসিএসে যোগদান করেছেন। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষক সংকট কল্পনাতীত। বেশির ভাগ বিভাগ চলছে চার থেকে পাঁচজন শিক্ষক দিয়ে, যেখানে একজন শিক্ষককে বছরে ১০ থেকে ১২টি কোর্স নিতে হয়। এ কোর্সগুলো নেওয়ার পেছনের গল্প অনেকেরই অজানা, যেখানে দেশের সব অফিসের নির্দিষ্ট সময়সূচি আছে, শুধু জরুরি সেবা প্রদানকারী দু-চারটি অফিস বাদে, তাও সেখানে ডিউটি রোস্টার আছে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কোনো কাজের সময়সীমা নেই। সারা দিন একাডেমিক কাজ শেষ করে রাতে এসে পরের দিনের ক্লাস প্রেজেন্টেশন রেডি করা, পরীক্ষার খাতা দেখা আবার নিজের গবেষণার কাজে সময় দেওয়া। যারা প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের কথা আর নাই বললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতনের বাইরে শুধু এ পারিতোষিক পেয়ে থাকেন, যা আবার শর্তসাপেক্ষ, কেউ যদি কোর্স না নেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেন, তাহলে তিনি কোনো পারিতোষিক পাবেন না। পারিতোষিকটা সম্পূর্ণ শিক্ষকদের শ্রম ও ঘামের টাকা, ফলে এভাবে কাটাছেঁড়া করে নতুন আর্থিক নীতিমালার নামে শিক্ষকদের প্রাপ্য কষ্টার্জিত পারিতোষিক কমিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অশান্ত করা খুব ভালো বার্তা দেয় না।

ইউজিসি যে নতুন আর্থিক নীতিমালা করেছে, সেখানে পারিতোষিকের যে হার উল্লেখ আছে, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার দ্বিগুণ সুবিধা পেয়ে থাকে, ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ওই হারের চেয়ে একটু বেশি অর্থ পেয়ে থাকে। তাহলে ইউজিসি কর্তৃক সব জেনেবুঝে এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে কাটছাঁট করে আর্থিক নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে ধারণা করা যেতেই পারে।

ইতোমধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয় এ নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশনও কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত, সেখানে সমস্যগুলোর দিকে নজর না দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে এমন নীতিমালা চাপিয়ে দিলে শিক্ষকরা মাঠে নামতে বাধ্য হতে পারেন। সরকারের আমলা, সচিবরা প্রতিমাসে জ্বালানি বাবদ জনপ্রতি অর্ধলক্ষ টাকা পেয়ে থাকেন, কমিটির নামে সরকারের লাখ লাখ টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকান, হাজার টাকার বালিশের দাম আমলাদের হাতে কোটি টাকা হয়। এসব খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোটা খুব জরুরি। শিক্ষকদের পারিশ্রমিকের অল্পকিছু টাকার প্রতি যাদের অশুভ দৃষ্টি পড়েছে, নিশ্চয়ই তারা কোনো শিক্ষক নন, কারণ পারিতোষিকের টাকা সভায় উপস্থিত হলেই পাওয়া যায় না, রাত জেগে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল তৈরি ও আলাদা দায়িত্ব পালনের জন্য দেওয়া হয়।

এখন অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা আসলে কতটুকু সময়োপযোগী, তাও ইউজিসির খতিয়ে দেখা দরকার। ‘অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা অনুসরণে সব বিশ্ববিদ্যালয় একই হারে পারিতোষিক পাবে’, আপাতদৃষ্টিতে যে কেউ মনে করতে পারেন-এতে সমস্যা কী? প্রথমত, পারিতোষিক সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ কমিটিতে পাশ হওয়ার পর সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে পারিতোষিকের অনুমোদন হয়। বলা বাহুল্য, অর্থ কমিটি ও সিন্ডিকেটে ইউজিসির প্রতিনিধি, সরকারের সচিব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও থাকেন এবং তাদের সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক নীতিমালা পাশ হয়। ইজিসির যে অভিযোগ, এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য এ নীতি, এ খাতে তো বিশৃঙ্খল কিছু দেখছি না, তাহলে সুশৃঙ্খল একটি নিয়ম থাকার পরও কার স্বার্থের জন্য এ নীতি? এ প্রশ্ন করাটা দোষের কিছু নয়। আবার বড় চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য রয়েছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর কুড়িগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আয় এক হবে না, ঢাকার শিক্ষক রাজধানীতে থাকার কারণে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প বা কনসালটেন্ট অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন; কিন্তু প্রত্যন্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন না, সেক্ষেত্রে তার জীবিকা নির্বাহ করার জন্য বেতন ও পারিতোষিকের ওপর নির্ভর করতে হবে, আর বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী বাজারে আগে যা পেতেন, তা অর্ধেক করে দিলে কেমন হবে?

বেশির ভাগ শিক্ষকই মনে করেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে, যা নিয়ে কারও প্রশ্ন থাকার কথা না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন বাজেট একরকম নয়, পরীক্ষা পদ্ধতিও একরকম নয়। সেক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঠে না নামিয়ে ইউজিসির বরং উচিত হবে শিক্ষক সংকট নিরসন এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহায়তা করা।

সাইফুল ইসলাম : প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম