Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমরা বাঁচব তো? কতদিন?

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা বাঁচব তো? কতদিন?

আমি একজন নানা বিষয়েই অশিক্ষিত মানুষ। কিন্তু অশিক্ষিত মানুষেরও তো উদ্বেগ জাগে, উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। মানুষের বাঁচামরা নিয়ে উদ্বেগ। শুধু নিজের বাঁচামরা নিয়ে নয়, সেটা নিয়ে উদ্বেগ এখন অবান্তর; কিন্তু আমার সন্তানসন্ততির বাঁচামরা, সব মানবজাতির বাঁচামরা। হয়তো অন্য প্রজাতিদেরও বাঁচামরা।

এ অন্তহীন আর বিজ্ঞানী হাব্লের মতে ক্রমপ্রসারমাণ বিশ্বচরাচরে, যেখানে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মেলা; বিজ্ঞান বলে, সেখানে আমাদের এ পৃথিবী হলো একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ তৈরি হয়েছে, আর প্রাণ বেঁচে আছে। কোটি কোটি প্রাণসত্তার জন্ম হয়েছে, আবার কোটি কোটি জীব চিরকালের মতো মুছেও গেছে পৃথিবী থেকে। আর এ জীবের মধ্যে একটি হলো মানুষ, যে নিজেকে নিয়ে নিজের চারদিকে এক আশ্চর্য, অভাবিত সভ্যতা নির্মাণ করেছে। অন্য প্রাণীগুলো শুধু বেঁচে থেকেছে, আর মানুষ বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে আরও কত কী করেছে তার ইয়ত্তা নেই-আকাশ-চমকানো ঘরবাড়ি, মোটরগাড়ি, ট্রেন, প্লেন, গ্রহান্তরে যাওয়ার রকেট, কত প্রতিষ্ঠান, সমাজ, দেশ, জাতিসংঘ, শেকসপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, বেটোফেন, পিকাসো, বিপুলসংখ্যক মানুষকে গরিব করে রাখার চমৎকার ফন্দি বা একসঙ্গে নির্বিবাদে খুন করার অস্ত্র-কী তৈরি করেনি সে? অন্ধ প্রকৃতি কী এক অসংগত পক্ষপাত দেখিয়েছে মানুষকে। তাকে ভাষা দিয়েছে। দিয়েছে বলেই না তার এত রমরমা, এত দম্ভ!

এমন যে মানুষ, সে যদি দম্ভ করে বলে, গ্রিক দার্শনিক প্রোতাগোরস যেমন বলেছিলেন, ‘মানুষই সবকিছুর পরিমাপ’-Man is the measure of all things, তা তো সে বলতেই পারে। রেনেসাঁসের পর থেকে এ কথা সে বলেই চলেছে অক্লান্তভাবে। উনিশ শতকে এসে বাঙালি কবি মানুষকে দেবতা বানিয়ে বন্দনাও করেছেন, ‘নমি আমি নরদেব! কী গর্বে গৌরবে দাঁড়ায়েছ তুমি!’ তার শক্তি আর লোভ আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।

ফলে খুব সহজভাবেই পৃথিবীর প্রভুত্ব মানুষের ওপর বর্তেছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’-এ কথাটার কদর্য কদর্থ করে এই প্রভুত্ব সে তুমুল আর দিশাহীনভাবে উপভোগ করেছে। সেই সুযোগে মানুষ ছাড়া অন্যদের আর অন্য কিছুর জীবন সে ছারখার, তছনছ করে নরক করে দিয়েছে। সে এমন ভয়ংকর দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছে যে, আর সব জীব, নিসর্গ আর বস্তু তৈরি হয়েছে শুধু মানুষেরই জন্য, তাদের নিজেদের কোনো মূল্যই নেই, সার্থকতাই নেই। তারা মানুষের ব্যবহার আর সম্ভোগের জন্য শুধু, আর কিছু নয়। তাই মানুষ তাদের খেয়েছে, মেরেছে, অকারণে মেরে তাদের ওপর পা রেখে হ্যাট মাথায় গোঁফ চুমরিয়ে ছবি তুলেছে। ঘরবাড়ি, যানবাহন তৈরি করেছে; পশু (একসময় মানুষকেও) দিয়ে সেই যানবাহন টানিয়েছে, চাষ, ফসল মাড়াই, তেল তৈরি, আরও কত কাজ করিয়েছে। যেন মানুষের জন্য আত্মপীড়ন আর আত্মধ্বংসকেই তারা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। ঈশ্বরের কথা জানি না, কারও কাছে তাঁর, আর প্রকৃতির নাকি এই বিধান।

২.

তো এখন শুনছি, গত শতাব্দী থেকেই শুনছি, এখন নাকি তার একটা হিসাবনিকাশ তৈরি করছে প্রকৃতি। হঠাৎ এই পৃথিবীর মানুষের দিকে কারা নানা অস্বস্তির ধাক্কা ছুড়ে মারতে শুরু করেছে। আমি তো সব বুঝিও না। শুনছি পৃথিবীর উপরকার ওজোন গ্যাসের আবরণে কী সব ফুটোফাটা হয়েছে মানুষেরই দুষ্কর্মে, তাই পৃথিবীর গরম বাড়ছে, মানুষের সহনশক্তিকে বিদ্রুপ করে। পর্বতের চূড়ায় জমে থাকা বরফ আর হিমবাহগুলোও গলছে। নগরায়ণের নিষ্ঠুর বিস্তার ঘটছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়, গাছ কাটা হচ্ছে অস্বাভাবিক উৎসাহে, নগরসংলগ্ন ডোবা-জলাশয় বুজিয়ে বহুতল উঠছে। কৃষি আর মানুষের কাজে মাটির নিচের জলস্তর নামছে অতিদ্রুত, এরই মধ্যে (১৪ এপ্রিল, ২০২৩) দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনে নাকি তাদের মিউনিসিপ্যালিটি বলে দিয়েছে যে, তারা আর নাগরিকদের স্নান-পানের জল সরবরাহের দায়িত্ব নিতে পারবে না। আমাদের দেশেও খরা অঞ্চলে শুনছি মিউনিসিপ্যালিটি দিনে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি জল দিতে পারছে না।

জল, যার আরেক নাম জীবন আমরা শিখেছি ছোটবেলায়, তার উৎস যদি শুকিয়ে যেতে থাকে, নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে, আমরা বাঁচব কেমন করে? মাটির তলার জল কমছে, মাটির উপরের জল কমছে, আকাশ থেকে নেমে আসা জল কমছে। আর শুধু তাই নয়, জলের সঙ্গে মিশছে আর্সেনিক, মানবদেহের এক প্রবল শত্রু। জল তো শুধু মানুষের স্নান-পানের জন্য নয়, জল মানুষের খাদ্যের, চাষের জন্য; আরও কত প্রয়োজন মেটায় জল। পৃথিবীর সেই জল শুষে নিচ্ছে কে? এ প্রশ্ন যদি কোনো মানুষ করে, যে উত্তর তার দিকে ধেয়ে আসবে, তা হলো, ‘সে নিজে’।

শুধু ফুরিয়ে যাওয়ার সংকট নয়, যা আছে তার দূষণেরও সমস্যা। জল যেমন জীবন, তেমনই বায়ুও তো মানুষের জীবন, কারণ বাতাসের এক উপাদান অক্সিজেন নিজের নিশ্বাসে না নিলে মানুষ বাঁচে না। এ বাতাসকেও মানুষ প্রতিদিন দূষিত করে চলেছে। মোটর-ট্রাকের পেছন থেকে পেট্রোল-ডিজেলের কার্বন-মনোক্সাইডভর্তি ধোঁয়ায় শহরের বাতাস বিষাক্ত ও মন্থর, গলা আর ফুসফুসের অসুস্থতা দ্রুত বাড়ছে। মাটির তলার কয়লা আর তেল তোলা হচ্ছে পাগলের মতো, পৃথিবীর বুকের এসব সম্পদ ফুরিয়ে এলো বলে। আর ওই অক্সিজেন মানুষের জন্য সম্পূর্ণ বিনা প্রার্থনায় তৈরি করে যে অরণ্য, তাও তো আমরা প্রতিদিন বিনাশ করে চলেছি। নিজেদের রুগ্ণতা আর মৃত্যুকে এমন করে আমন্ত্রণ মানুষ ছাড়া আর কে করতে পারে!

৩.

নাগরিক জীবন তো মহাফুর্তিতে তৈরি করলাম, কিন্তু তার নির্মলতার দিকেও কি আমাদের কারও নজর আছে? আমরাই তো নিজেদের সম্পদের যেমন অপচয় করি, তেমনই পরিবেশকে নোংরা করে রাখি। সত্তর বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একটি হোস্টেলে দেখেছিলাম এক নগ্ন শরীর আমেরিকান ছাত্র শরিকি স্নানের ঘরে পুরোদমে শাওয়ার খুলে দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে। সেই বেমালুম অপচয়ের ছবি আমার মন থেকে এখনো মোছেনি। আর দূষণ? তাতে আমাদের ভূমিকা তো প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। পরিবেশবিদদের পরামর্শ তুচ্ছ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার করেই চলেছি, পথে-ঘাটে নোংরা ফেলার মহোৎসবে মত্ত আমরা। আর ধাপায় জমা করা এ নোংরা ঘাঁটতে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষই বাজ পড়ে মারা যায়। পথঘাট আবর্জনার স্তূপে ভরে ওঠে, জল দূষিত হয়ে মাছের মৃতদেহ উপহার দেয় আমাদের।

জানি, বিজ্ঞানীরা যা ফুরিয়ে যাচ্ছে তার রক্ষা বা বিকল্পের কথা ভাবছেন। অসুখের সঙ্গে ওষুধের আবিষ্কার হচ্ছে। অপচয়ের জায়গায় পুনর্নবায়ন বা রিসাইক্লিংয়ের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু তবু মনে হয় বড় বেশি দেরি হয়ে গেল। এ দেরির জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের বোধ এখনো দ্বিধাগ্রস্ত, আমরা যে পৃথিবী আর জীবন ধ্বংসের এ বীভৎস উদ্যোগে উদাসীন অংশীদার, তা আমরা ভাবতেই শুরু করিনি।

আমার জীবন তার শেষ চৌকাঠে এসে ঠেকেছে। আমি এসব প্রকল্পে কোনো বিষয়ই নই। কিন্তু আমার সন্তানদের, সন্তানদের সন্তানদের জন্য আরেকটু শুদ্ধ পৃথিবী রেখে যাওয়ার কথা ভাবার তো এখনই সময়। নাকি আরও কিছু কোভিড মহামারির জন্য অপেক্ষা করব পৃথিবী থেকে মানুষ নামের জঞ্জালকে সাফ করে দেওয়া হবে বলে?

পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম