Logo
Logo
×

বাতায়ন

ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচাতে হবে

Icon

আতাহার খান

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচাতে হবে

ফাইল ছবি

দেশের উত্তরের জেলাগুলোয় এখন পানি বাড়া শুরু হয়ে গেছে। কারণ, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সেই বন্যার পানি বাংলাদেশের নদ-নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। সেই অর্থে ব্রহ্মপুত্র নদেও পানি কিছুটা বেড়েছে। অথচ কদিন আগে এ নদে ছিল হাঁটুপানি-ভাবতেই কেমন চমকে উঠি। কল্পনায় হোঁচট খাই আর কী! ঢাকার শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার একদম উপরের অংশে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশাল এক ছবিসহ খবরটি ছাপা হয় গত ৬ মে। সেই খবর পড়ে এবং ছবি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হই।

খবরে বলা হয়, ময়মনসিংহ শহরের কাছারিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ঠিক মাঝখানটায় হাঁটুপানি, সেখানে তৈরি করা হয় একটি প্রতীকী মঞ্চ। তার মানে হাঁটুপানিতে একটি টেবিল পেতে রাখা, তার উপর একটি পাত্রে আছে কিছু খাবার, কিন্তু সঙ্গে নেই খাবারের পানি আর টেবিলের পেছন দিকটায় এক মালাইয়ের একটি নৌকা, তার মাস্তুলের সঙ্গে টাঙানো সাদা কাপড়ের একটি পাল। তাতে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা ‘মৃতের চিৎকার’। প্রতিবাদকারীরা হাঁটুপানিতে দাঁড়ানো। তবলার সঙ্গে গিটার আর বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে এবং মূকাভিনয় ও কবিতা আবৃতি করে তারা ‘মৃতের চিৎকার’ নামে এ অভিনব কর্মসূচি পালন করেন।

প্রতিবাদকারীদের মধ্যে আছেন বিভিন্ন পেশার সচেতন মানুষ। তারা এসেছেন ময়মনসিংহ নগরী এবং বিভিন্ন উপজেলা থেকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ, খনন কাজে ছিল শুদ্ধাচারের অভাব। তারা আরও বলেছেন, গত ৫০ বছরে ব্রহ্মপুত্র নদে এত কম পানি দেখা যায়নি।

তবে বিআইডব্লিউটিএ বলেছে, খনন কাজ দ্রুত শুরু হবে। ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্প শুরু হয়। এ প্রকল্পের প্রথম খনন কাজ শুরু হয় এ প্রতীকী কর্মসূচি পালন করা স্থানটিসহ কাছারিঘাট এলাকায়। খননের পর সেখানে দেখা যায়, পুরো এলাকায় জেগে উঠেছে ছোট ছোট মাটির ঢিপি। প্রতিবাদকারীরা আরও বলেন, খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আমি আমার কিছু কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। তার আগে বলে রাখি, আমি কিন্তু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কেউ নই। আমার জন্মস্থান ফরিদপুর শহরে। এ শহরের উত্তরে ২ কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। তাছাড়া শহরের পুব দিকে টেপাখোলায় একসময়ে ছিল লঞ্চঘাট। নদীটির নাম ভূবেনশ্বর-পদ্মার শাখা নদী এটি। লঞ্চে ফরিদপুর-ঢাকা যাতায়াত করা যেত নিয়মিত। আমরা প্রতিদিন বিকালে টেপাখোলা লঞ্চঘাটে যেতাম। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীরা সিঁড়ি বেয়ে নামছেন, কুলিদের হাঁকডাক মুহূর্তেই সরব হয়ে উঠত পুরো লঞ্চঘাট। এ দৃশ্য আমরা উপভোগ করতাম। তবে আমরা লঞ্চঘাটে যেতাম দৈনিক পত্রিকার জন্য। এ লঞ্চেই আসত ঢাকা থেকে দৈনিক পত্রিকাগুলোর বান্ডিল। একদিন পরে আসত পত্রিকাগুলো। ফরিদপুর শহরের পশ্চিম অংশেও আছে আরও একটি নদী। বড় বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী, তার নাম কুমার নদ। সেখানেও ছিল লঞ্চঘাট। ফরিদপুর থেকে মাদারীপুর পর্যন্ত লঞ্চ যাতায়াত করত। শহরের উত্তরে ছিল চুনাঘাট দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণকায় আরও একটি নদী। আর শহরের দক্ষিণের শেষ সীমায় ছিল ঢোলসমুদ্র-বিশাল জলাশয়, আয়তনে প্রায় ফরিদপুর শহরের সমান হবে। শৈশব-কৈশোর বয়স থেকে এসব নদ-নদী-জলাশয় দেখে বড় হয়েছি। ফলে শৈশব থেকেই দেশের নদ-নদী বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ জন্ম নেয়। সেই থেকে এ বিষয়ে আমি কিছু জ্ঞান অর্জন করি। সে কথাগুলোই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

প্রথমে আসা যাক খনন প্রসঙ্গে। আমরা দেখে আসছি, কোনো নদীর নাব্য সংকট দেখা দিলে খননের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন-ব্রহ্মপুত্রের খনন প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নাব্য সংকট দূর করার জন্যই নদ-নদী খনন করা হয়ে থাকে। কিন্তু যে নদীর মাঝখানটায় হাঁটুপানি-সেখানে খনন করা মানে অহেতুক অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

ব্রহ্মপুত্র এক অর্থে একটি মৃত নদ। সেখানে খনন করলেই যে অঢেল পানি পাওয়া যাবে, এ ধারণার সঙ্গে আমি মোটেও একমত নই। কারণ, নদ-নদীতে নৌ-চলাচল পথ অক্ষুণ্ন রাখার প্রশ্নে খনন করা হয়ে থাকে। আমরা আরও জানি, নদীর নাব্য অবস্থা টিকিয়ে রাখা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরই একটি রুটিন কাজ। কিন্তু আজ ব্রহ্মপুত্র নদে পানি নেই, এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই বলছি, খনন করলে চারদিকের বালু চুইয়ে কিছু পানি আসবে সত্য, কিন্তু তাতে ব্রহ্মপুত্রের নাব্য অবস্থা ফিরিয়ে আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। একটি নদ বা নদীর পানি বয়ে আসে উজান থেকে। উজানে কোথাও বাধাগ্রস্ত না হলে পানির প্রবাহ অক্ষুণ্ন থাকে। উজান থেকে যদি কোনো কারণে পানি না আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে ভাটিতেও পানি আসবে না। বাহাদুরাবাদ থেকে ভৈরব বাজার পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের অবস্থাও দাঁড়িয়েছে তা-ই। বন্যা মৌসুম ছাড়া উজান থেকে আসতে পারে না। এটাই হলো বাস্তব অবস্থা। পানি কেন আসতে পারে না, সেই কারণটাই আগে খুঁজে বের করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসুন ব্রহ্মপুত্র নদ সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য জেনে নিই। হিমালয়ের পর্বতমালা কৈলাস শৃঙ্গের কাছে রয়েছে জিমা ইয়ংজং হিমবাহ। এটাই হলো ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল। এলাকাটি তিব্বতের পশ্চিম অংশে অবস্থিত। সেখানে জাংপো নামধারণ করে নদটি পুব দিকে অগ্রসর হয়-পরে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শিয়াং বা সিয়ং নামে এটি প্রবেশ করে। মজার ব্যাপার হলো, ব্রহ্মপুত্র নদ নানা জায়গায় নানা নামে অভিহিত, যেমন আসাম প্রদেশে প্রবেশ করার পর এ নদের নাম হয় দিয়াং। এ জলপ্রবাহ পশ্চিমমুখো হয়ে অগ্রসর হওয়ার পর দিবং ও লোহিত নামে দুটি বড় নদী এসে যোগ দেয় এর সঙ্গে। সম্মিলিত এ জলপ্রবাহ সমতল ভূমিতে নেমে এসে প্রস্থে বিশাল রূপ ধারণ করে। তখনই এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের মানে হলো ব্রহ্মার পুত্র। সমতল ভূমিতে এ নদ কোথাও কোথাও ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া রূপ নেয়। ব্রহ্মপুত্র আসামের ভেতর দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। জামালপুর জেলার পশ্চিমে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ দিয়ে জামালপুর জেলায় প্রবেশ করে। তারপর দক্ষিণ-পুব কোণ বরাবর শেরপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনায় মিলিত হয়। উৎপত্তি স্থল থেকে মেঘনায় পতিত হওয়া অবধি ব্রহ্মপুত্র ২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার (১,৭৭০ মাইল) পথ অতিক্রম করে।

কিন্তু ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সাল অবধি বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প আঘাত হানে এ অঞ্চলে। এতে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ উঁচু হয়ে ওঠে। তার ওপর ছিল বছর বছর বন্যার মারাত্মক প্রকোপ। এতে এর গতিপথ পালটে যায়। ব্রহ্মপুত্রের মূলপ্রবাহ তখন বাহাদুরাবাদের পশ্চিমে দক্ষিণমুখো হয়ে জোনাই নামক একটি খালের ভেতর দিয়ে বইতে শুরু করে। সেই থেকে এ জোনাইয়ের নাম হয় যমুনা। এরপর সোজা দক্ষিণমুখী ৫০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যমুনা, আরিচা ও গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার মাঝ বরাবর প্রবাহিত পদ্মায় এসে মিলিত হয়। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পালটে যাওয়ায় বাহাদুরাবাদ থেকে ভৈরব বাজার অবধি একসময়ের বিশাল প্রশস্ত এ নদ ধীরে ধীরে খরস্রোত হারিয়ে শুধু দুর্বলই নয়, রুগ্ণ এবং পানিশূন্যতায়ও জর্জরিত হয়ে পড়ে।

কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছে, খনন কাজ দ্রুত শুরু হবে। এখানেই আমার আপত্তি। ব্রহ্মপুত্রকে মৃত অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে তুলতে হলে খনন প্রক্রিয়া সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হতে পারে না। আমাদের সরেজমিন দেখতে হবে, উজান থেকে পানি কেন আসছে না। খুঁজে বের করা উচিত মূল কারণ। আমরা জানি, ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ উঁচু হয়ে ওঠায় এর মূলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয়। সন্দেহ নেই, এটি একটি প্রধান কারণ। এর সঙ্গে আছে আরও কিছু কারণ। তার একটি হলো, এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা হলো ব্রহ্মপুত্রের একটি প্রধান উপনদী। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা চরগুলোর অবস্থানগত কারণে তিস্তার মূলপ্রবাহ কয়েকটি চ্যানেলে ভাগ হয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রবাহিত হয়। তার ভেতর একটা প্রধান চ্যানেল দক্ষিণ-পুব কোনাকুনি এসে বাহাদুরাবাদ দিয়ে ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহিত হতো। সেই চ্যানেলটি এখন বন্ধ। কারণ, বাংলাদেশের উজানে তিস্তার পুরো পানি গজলডোবা বাঁধ দিয়ে সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা বাধ্য হয়ে মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। তাকে টুঁটি চেপে হত্যা করার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নদী আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা দেখানো হয়নি; বরং তা একতরফাভাবে অমান্য করা হচ্ছে। শুধু বন্যার সময়েই দিনকয়েকের জন্য তিস্তার পুরো পানি ছেড়ে দেওয়া হয় ইচ্ছাকৃতভাবে। এতে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় শতগুণ দুর্দশায় নিমজ্জিত হয় তিস্তা অববাহিকার মানুষজন। বন্যার প্রকোপ কমে এলে আবার গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানি সরিয়ে নেওয়া হয়। বন্যার কয়েক দিন ছাড়া প্রায় সারা বছরই বাংলাদেশের তিস্তা অংশটুকু প্রায় মৃত অবস্থায় টিকে থাকে কোনোক্রমে। তাই কালবিলম্ব না করে তিস্তা চুক্তি কার্যকর করা উচিত। তিস্তা তার যৌবন ফিরে পেলে বাহাদুরাবাদ থেকে ভৈরব বাজার অবধি ব্রহ্মপুত্রও ফিরে পাবে প্রাণ।

এবার আসা যাক মূল ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য চর প্রসঙ্গে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন চর জেগে উঠছে, আবার কিছু চর ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই চরগুলোর আয়ু ক্ষণস্থায়ী। এসব চরের অবস্থানগত কারণে এর মূল প্রবাহও ঘন ঘন দিক পালটায় এবং তা বেশকিছু চ্যানেলে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হয়। এসব চ্যানেলের মধ্য থেকে একটি বা দুটি চ্যানেল যদি বাহাদুরাবাদের মুখ দিয়ে কিংবা নতুন খাল খনন করে প্রবাহিত করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে মৃত ব্রহ্মপুত্রকে আবার বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে। সময়ক্ষেপণ না করে জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এসব বিষয় নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করা। আমাদের দরকার সমস্যার সমাধান। অন্তত এর অববাহিকায় বসবাস করা মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ব্রহ্মপুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে আনা চাই দ্রুত।

কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমরা দেখি অন্য ছবি। খনন কাজ নিয়ে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ নিয়ে মস্ত বড় এক ‘কিন্তু’ সামনে এসে দাঁড়ায়। হাঁটুপানির একটি নদকে শুধু খনন করে বাঁচানো যাবে না।

আগে দেখতে হবে উজান থেকে কেন পানি আসে না। খুঁজে বের করা উচিত নেপথ্যে থাকা দীর্ঘদিনের সেই প্রতিবন্ধকগুলো। এসব দূর না করে কীভাবে সম্ভব হবে ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানো?

আতাহার খান : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম