Logo
Logo
×

বাতায়ন

কুরবানির পশুর হাট হোক বিড়ম্বনামুক্ত

Icon

সামছুল আলম

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কুরবানির পশুর হাট হোক বিড়ম্বনামুক্ত

একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশ ঈদুল আজহায় কুরবানির পশুর জন্য ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা অনেকটাই কমে গেছে।

প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কুরবানির পশু নিয়ে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ সরকার এবং খামারিরা উপলব্ধি করেন, দেশের ভেতরেই গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেই তখন থেকেই প্রাণিসম্পদ খাতে সরকারের প্রচেষ্টা এবং খামারি ও গবেষকদের অবদানের জন্যই আজ বাংলাদেশে কুরবানির পশুর জন্য পরনির্ভরশীলতা কমে এসেছে, এমনকি গত কয়েক বছর ধরে কুরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকছে।

এখন পশু উদ্বৃত্ত থাকলেও ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ভেজাল (অর্গানিক নয়) পশু নিয়ে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় প্রতিবছর কুরবানির ঈদ সামনে রেখে একদল অসাধু ব্যবসায়ী কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই গরু মোটাতাজা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করেন। এতে গরুর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরুর কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃৎ নষ্ট হতে থাকে এবং গরুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায়। পশুকে স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা পশুর প্রস্রাব বন্ধ করে দেয়। ফলে পশুর চামড়ার নিচে পানি জমতে থাকে এবং পশুর শরীরের সেলগুলো ফুলে যাওয়ায় পশুকে স্বাস্থ্যবান দেখায়। এ প্রক্রিয়া পশুর জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনই ওই পশুর মাংস যারা খায় তাদের জন্যও ক্ষতিকর। তবে মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইনের ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে, গবাদিপশুর হৃষ্টপুষ্টকরণে কোনো ধরনের হরমোন, স্টেরয়েড এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

দেশে গরু মোটাতাজাকরণকে দুই ভাগে করা যায়। একটি রেগুলার, অন্যটি সিজনাল। এর মধ্যে সিজনাল অর্থাৎ ঈদ সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের প্রবণতা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণীদেহে স্টেরয়েড বা ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে এসব ওষুধ ছাড়া বৈজ্ঞানিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করতে হলে কমপক্ষে ৯০-১২০ দিন আগে থেকে গরুর লালন-পালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভোক্তাদের মধ্যে ভেজালমুক্ত কুরবানির পশু সরবরাহ করতে সরকারি পর্যায়ে ইতোমধ্যে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলায় কর্মরত কর্মকর্তারা খামারিদের নিরাপদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রশিক্ষণে স্টেরয়েড/হরমোন অপপ্রয়োগের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং খামারিরা তদানুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, চলতি বছর ৭২ হাজার ৫৬৩ খামারিকে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

কুরবানিযোগ্য পর্যাপ্ত পশু থাকলেও একশ্রেণির অসাধু, অতিমুনাফালোভী কারবারি নানাভাবে পশুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে। এতে করে ভোক্তা পর্যায়ের সাধারণ মানুষ নানা ভোগান্তির শিকার হয়। অন্যদিকে ছোট ছোট সাধারণ খামারিরাও ক্ষতির সম্মুখীন হন। এসব ক্ষতি থেকে খামারিদের রক্ষা করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব উদ্যোগের একটি হলো অন্যান্য বছরের মতো এবারও রেলে কুরবানির গবাদিপশু পরিবহণ করা হবে। যে অঞ্চলে গবাদি পশুর উৎপাদন বেশি, সে অঞ্চল থেকে যে অঞ্চলে উৎপাদন কম সে অঞ্চলে রেলের মাধ্যমে পশু পরিবহণ করা যাবে। এক্ষেত্রে রেল বিশেষ সুযোগ দেবে। কম খরচে পশু পরিবহণের সুযোগ করে দেবে। দেশের সর্বত্র যাতে কুরবানির পশু পর্যাপ্ত থাকে সে অনুযায়ী পশু পরিবহণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

তাছাড়া খামারিরা যাতে পছন্দ অনুযায়ী হাটে কুরবানির পশু বিক্রি করতে পারেন এবং জোর করে কেউ পথে পশু নামাতে না পারে সেজন্য খামারিরা চাইলে ৯৯৯-এ যোগাযোগ করতে পারবেন। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এবার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, কেউ খামারে পশু বিক্রি করলে তার কাছ থেকে হাসিল আদায় করা যাবে না। কোনো খামারি নিজ বাড়ি থেকে পশু বিক্রি করলেও তাকে হাসিল দিতে হবে না। হাটে আনার পথে কেউ পশু বিক্রি করলে তার কাছ থেকে ইজারাদার জোর করে চাঁদা বা হাসিল আদায় করতে পারবে না। পশুর যেন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য হাটে আনার পথে, এমনকি বাড়িতেও পশু বিক্রি করা যাবে। তবে রাস্তায় হাট বসানো যাবে না। এছাড়া ডিজিটাল হাটের মাধ্যমেও পশু বিক্রি করা যাবে। সব সিটি করপোরেশন ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন/গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইনে গবাদি পশু বেচাকেনার উদ্যোগে সহযোগিতা দেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে সুস্থ ও অসুস্থ গরু চিনতে পারবে সে ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে বার্তা প্রচার করে যাচ্ছেন। এসব বার্তার মাধ্যমে কুরবানির পশুর হাটে একজন ক্রেতা সহজেই বুঝতে পারবে গরুটি সুস্থ নাকি অসুস্থ। রাসায়নিক বা ওষুধ দেওয়া গরুর মাংসপেশি থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়। গরুর শরীরে পানি জমার কারণে বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে সেখানে গর্ত হয়ে দেবে যায় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেয়। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত ওজন হওয়ায় এসব গরু স্বাভাবিক নড়াচড়া ও চলাফেরা করতে পারে না ও শান্ত থাকে। রাসায়নিকযুক্ত গরু ভীষণ ক্লান্ত থাকে ও ঝিমায়। অন্যদিকে সুস্থ গরুর গতিবিধি থাকে চটপটে। কান ও লেজ দিয়ে মশা-মাছি তাড়ায়। তৃতীয়ত, সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশটা ভেজা থাকে বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকে। অন্যদিকে অসুস্থ গরুর নাক থাকে শুকনা। ভেজাল ওষুধ খাওয়ানো গরুর শরীরের অঙ্গগুলো নষ্ট হতে শুরু হওয়ায় এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত নেয়। মনে হবে হাঁপাচ্ছে। চতুর্থত, অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেওয়া গরুর মুখ থেকে প্রতিনিয়ত লালা ঝরে। এসব গরু কিছু খেতে চায় না। অন্যদিকে সুস্থ গরুর শরীরের রং উজ্জ্বল, পিঠের কুঁজ মোটা, টানটান ও দাগমুক্ত হয়। সুস্থ গরুর রানের মাংস শক্ত থাকে। আর রাসায়নিক দেওয়া গরুর পা হয় নরম থলথলে। পঞ্চম লক্ষণ হলো, যদি গরুর শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় (১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি) তাহলে বুঝতে হবে গরুটি অসুস্থ। ষষ্ঠ লক্ষণ হলো, সুস্থ গরুর চামড়ার উপর দিয়ে কয়েকটা পাঁজরের হাড় চোখে পড়ে। সুস্থ গরু বাঁধা অবস্থায় প্রায়ই যেনতেনভাবে ছুটতে চায়। ঘন ঘন লেজ নাড়ে। হাঁকডাকে জোরালো হয়। দুরন্ত হয়। সুস্থ গরু চেনার আরেকটি অন্যতম উপায় হচ্ছে জাবর কাটা। অসুস্থ গরুর শরীরে তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং পাতলা পায়খানা হয়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। সামনে খাবার থাকলেও খায় না, এমনকি জাবরও কাটে না।

স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে এবং কুরবানির পশুর চামড়ার মান বজায় রাখতে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গবাদি পশু কুরবানির জন্য এবং চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণ বিষয়ে ইতোমধ্যে ১৫ হাজার ১৩২ জন পেশাদার কসাই এবং ১৬ হাজার ৬৬৭ জন মৌসুমি কসাইসহ সর্বমোট ৩১ হাজার ৭৯৯ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষ্যে সড়কের উপরে যত্রতত্র কুরবানির পশু জবাই না করে যথাসম্ভব নির্ধারিত স্থানে কুরবানি করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি অফাল (নাড়িভুঁড়িসহ অন্যান্য বর্জ্য) যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করার জন্য সিটি করপোরেশনসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভেজালমুক্ত কুরবানির পশু এবং বিড়ম্বনাহীন পশুর হাট উপহার দেওয়ার এ উদ্যোগ সফল হোক।

কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর

alam4162@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম