Logo
Logo
×

বাতায়ন

হাওড়ের জীবন-জীবিকা উন্নয়নে করণীয়

Icon

সেলিম আহমদ

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাওড়ের জীবন-জীবিকা উন্নয়নে করণীয়

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি জেলাজুড়ে বিস্তৃত হাওড়াঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্য কোনো অঞ্চলের তুলনা চলে না। এটা ঠিক, বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এদেশে যেমন দিগন্ত বিস্তৃত সাগর রয়েছে, তেমনি রয়েছে আঁকাবাঁকা নদী। যেমন রয়েছে পাবর্ত্যাঞ্চল, তেমনি রয়েছে সমতলভূমি। যেমন রয়েছে বনভূমি, তেমনি রয়েছে বিল অঞ্চল। দেশের এসব ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই নিজের মধ্যে ধারণ করে রয়েছে হাওড়াঞ্চল।

এখানে পাহাড়, নদী, বিল, বনভূমি, সমতলভূমি-সবই রয়েছে। আর বর্ষাকালে হাওড় হয়ে ওঠে সাগরের মতোই বিস্তৃত ও বিস্তীর্ণ। বস্তুত ‘হাওড়’ শব্দটি সাগরেরই অপভ্রংশ। আর হাওড়াঞ্চলের কেন্দ্রভূমি হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলা। এ জেলার পুরোটাই হাওড়াঞ্চল।

ভৌগোলিক দিক ছাড়াও হাওড়াঞ্চলের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য গুরুত্বপূর্ণ। লোকগান বা লোকনাট্যের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধারার বিকাশ ঘটেছে এ হাওড়াঞ্চলে। ধামাইল গান, ঘেটুগান ছাড়াও বাউল, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি গান প্রচলিত এখানে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে প্রচলিত রয়েছে আরও নানা লোকাচার ও সংস্কৃতি। লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ প্রভৃতি আয়োজনেও হাওড়াঞ্চল অনন্য।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাওড়ের জীবন ও জীবিকা। এখানকার জনজীবন ও অর্থনীতি দেশের আর কোনো অঞ্চলের সঙ্গে মিলবে না। কথায় আছে-‘হাওড়ে ছয় মাস নাও, ছয় মাস পাও’। এ অঞ্চল বছরের ছয় মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। আর ছয় মাস থাকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর হয়ে। বর্ষায় যেখানে দিগন্তজুড়ে বড় বড় ঢেউ খেলা করে, শুকনো মৌসুমে সেখানে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় হিল্লোলিত ধান ক্ষেত।

অবশ্য হাওড়াঞ্চলের জীবন-জীবিকা এমন ছবির মতো সহজ নয়। সাত জেলার ২৯টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় এক কোটি মানুষের প্রধান জীবিকা এক ফসলি বোরো ধান। কেউ কেউ মাছ ধরা বা গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি লালন-পালনে জড়িত। কিন্তু কারও হাতেই সারা বছর কাজ থাকে না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো তিন ফসলি জমি থাকলে কিংবা বছরজুড়ে মাছ ধরা গেলে হয়তো জীবন সচ্ছল থাকত।

বিশেষত, বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের বেকারত্ব একটি যুগবাহিত সমস্যা। স্বীকার করতে হবে, এককালে উর্বর ভূমির উৎপাদনশীলতা, জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির আধিক্য, মৎস্য ও পশুসম্পদের প্রাচুর্য হাওড়বাসীর সচ্ছল ও সরল জীবযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যায়, অন্যদিকে নদী-বিল-খাল ভরাট হয়ে মাছের উৎপাদন কমে যায়। এছাড়া কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের প্রজনন ও উৎপাদনও কমে গেছে। কৃত্রিম সেচের আওতায় বোরো ধান চাষ বাড়ায় গোচারণ ভূমিও কমে যায়।

এটা ঠিক, এখনো বোরো মৌসুমে দেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওড়াঞ্চল থেকে। কিন্তু সেটাও আর টেকসই জীবিকা হিসাবে থাকছে না। কারণ ক্রমাগত কৃষি উপকরণ তথা বীজ, সার, ডিজেল বা বিদ্যুৎ, কীটনাশক, সেচপাম্প, পাওয়ার টিলারসহ অন্য কৃষিযন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। এতে ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। সেই অনুযায়ী ভরা মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পায় না। ফসল ঘরে তোলার ৩-৪ মাস পর ধানের মূল্য কিছুটা বাড়ে বটে, ততদিনে প্রান্তিক ও মাঝারি চাষি ধান বিক্রি করে ফেলে। তাদের পক্ষে ওই ফসল গুদামজাত করে রাখা সম্ভব হয় না। সবমিলিয়ে লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। এ পরিস্থিতিতে হাওড়াঞ্চলের মৎস্যজীবী ও চাষিরা ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন।

স্বীকার করতে হবে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু হওয়ায় হাওড়াঞ্চলে শিক্ষার হার এবং সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বেকার জনশক্তির একটি ক্ষুদ্রাংশ শহরে ও শিল্পাঞ্চলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী হচ্ছে। হাওড়াঞ্চলে শিল্পাঞ্চল ও ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে তারা নিজ ভূমিতেই থেকে যেত।

এ পরিস্থিতিতে হাওড়াঞ্চলে জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যেমন হাওড়াঞ্চলের কোথাও কোনো ধরনের কারিগরি শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান না থাকায় দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। হাওড়াঞ্চলের প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে কারিগরি বিদ্যালয় বা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করা যেতে পারে। হাওড়াঞ্চলের কিশোরগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় এভাবে একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

হাওড়ে সহজলভ্য কাঁচামাল যেমন-ধান, মাছ, গবাদি পশুভিত্তিক এবং শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে হাওড়াঞ্চলে। তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে রয়েছে। হাওড়াঞ্চলে উদ্বৃত্ত শ্রম বিবেচনায় পোশাক কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া অটোমেটিক রাইসমিল এবং আধুনিক মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও পশুসম্পদ পালন ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এসব শিল্পের ফিডমিল স্থাপনেও হতে পারে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক ও অর্থকরী প্রতিষ্ঠান, পিকেএসপি, ইডকল, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে হাওড়াঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত কর্মসংস্থান প্রকল্প নিয়ে। সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ কেন্দ্র খোলা যেতে পারে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের যথাযথ ঋণ ও তদারকির মাধ্যমে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সহায়তা করা যেতে পারে। পাশাপাশি হাওড়াঞ্চলে পর্যটন শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মেরামত এবং সংযোজন, কৃষি ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছ ধরার জাল, মশারি, জানালার নেট ও পর্দা তৈরি, হোসিয়ারি শিল্প, সোলার প্যানেল, এনার্জি সেভিং ল্যাম্প, যান্ত্রিক নৌযান তৈরি ও মেরামত, উন্নত ও দ্রুতগামী ও আরামদায়ক নৌপরিবহণ, সড়ক পরিবহণ শিল্প, চারকোল ব্লক ইত্যাদি শিল্প স্থাপন সম্ভব।

হাওড়াঞ্চলের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য ও পর্যটন সম্পর্কের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার যদি সম্ভব হয়, তাহলে হাওড়াঞ্চল হয় উঠবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যকেন্দ্র। হাওড়াঞ্চলের জীবন ও জীবিকা উন্নয়নে তাই প্রয়োজন আধুনিক চিন্তাধারা ও ভবিষ্যৎমুখী নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব হাওড়বাসীকে স্বপ্ন দেখাতে এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। হাওড়াঞ্চলের যে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যে ভৌগোলিক সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা কাজে লাগাতে হলে বলিষ্ঠ ও জনদরদি নেতৃত্বের বিকল্প নেই।

হাওড়াঞ্চলের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির মডেল সূচিত হতে পারে হাওড়াঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র সুনামগঞ্জ থেকে। এসব বিষয়ে এলাকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী, অন্যান্য পেশাজীবী এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, হাওড়াঞ্চলের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন মানে আমাদের সবারই উন্নয়ন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে, হাওড়াঞ্চল সেখান থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে না। এ জন্য হাওড়াঞ্চল তথা সুনামগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে যার যার সাধ্যমত চিন্তাভাবনা ও কাজ করতে হবে।

সেলিম আহমদ : সভাপতি, সুনামগঞ্জ ফাউন্ডেশন; রাজনীতিক ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম