ড. বদিউল আলম মজুমদার গণতন্ত্র, নির্বাচন, উন্নয়ন ও সুশাসন ইত্যাদি নিয়ে এ দেশের সিভিল সোসাইটির অন্যতম সরব কণ্ঠ। বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং তিনি এ সংস্থার গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
স্বনামধন্য নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। ১ মে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টে তার সম্পৃক্তির ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ত্রিশ বছর একজন ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য নিতান্ত কম সময় নয়। এ ৩০ বছর ড. মজুমদার, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট ও বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনের জন্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
১৯৯৩ সালের এপ্রিলে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, ক্ষমতায়িত এবং কমিউনিটিকে সংগঠিত করে আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রমী উন্নয়ন ধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন ধারার মাধ্যমে তিনি স্বেচ্ছাব্রতী কার্যক্রমের ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।
তার উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় দি হাঙ্গার প্রজেক্ট উজ্জীবক প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী অসংখ্য মানুষের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং তারা নতুন উদ্দীপনায় নিজের ও সমাজের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে নিয়োজিত হন। দেশের তরুণদের সম্ভাবনার বিকাশে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে তার অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগে ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে বর্তমানে এক লাখেরও বেশি স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ-তরুণী কাজ করছেন। একইসঙ্গে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠার কাজেও তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ও বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে ২০০২ সালে ‘সিটিজেন্স ফর ফেয়ার ইলেকশন্স’ নামে একটি নাগরিক সংগঠন গঠিত হয় এবং তিনি এর সদস্য সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে সংগঠনটি নাম পরিবর্তন করে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নাম ধারণ করে। ২০০৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে বদিউল আলম মজুমদার এবং মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পেশা, আয় ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহ করে তা ভোটারদের মাঝে প্রচার করে।
এর মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ভোটারদের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বিচারপতি আবদুল মতিন ও বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৫ সালে একটি যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে হলফনামা আকারে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেন।
২০০৭ সালে একটি স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক আদালতের রায়কে ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে আবু সাফা নামক জনৈক ব্যক্তিকে দিয়ে আপিল করানো হলে এবং তা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কর্তৃক গৃহীত হলেও সুজন’র সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও আইনি পদক্ষেপে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের মৃত্যুর পর ড. বদিউল আলম মজুমদার সুজন’র হাল ধরেন এবং সমমনা আরও বহু মানুষকে যুক্ত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি ও আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উচ্চ আদালত প্রদত্ত একটি যুগান্তকারী রায়ের পক্ষভুক্তদেরও একজন তিনি। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব পেতে কমিশন বরাবর আবেদন করে তথ্য পেতে ব্যর্থ হয়ে ড. মজুমদার ও আরও সমমনা কয়েকজন আদালতের দ্বারস্থ হন।
রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের তথ্য পাওয়া জনগণের অধিকার উল্লেখ করে আদালত ২০১৬ সালে রায় প্রদান করেন। কাজী হাবিবুল আউয়ালকে সিইসি করে দেশের ১৩তম নির্বাচন কমিশন গঠনের পর কমিশনারদের নাম প্রস্তাবকারীর তথ্য জানতে চেয়ে তার নেতৃত্বে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের হয়, যা বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতা সংক্রান্ত হাইকোর্টের এক মামলায় আদালত ড. বদিউল আলম মজুমদারকে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসাবে নিয়োগ দেন। আদালতের রায়ে ড. মজুমদারের লিখিত উপস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি বঞ্চনা ও নির্যাতনের অবসান এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একজন অগ্রসৈনিক। কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাওয়া জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সভাপতি হিসাবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রস্তাব এবং দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের কর্মসূচি ও আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সরকার ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসাবে পালনের ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরে জাতিসংঘ ১১ সেপ্টেম্বরকে ‘ডে অব দ্য গার্লস’ ঘোষণা করে।
তিনি ২০০১ সালে বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) বোর্ড অব গভর্নরস সদস্য এবং ২০০৭ সালে সাবেক সচিব ড. শওকত আলীর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি’র সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটির মাধ্যমে ওয়ার্ড সভা আয়োজন, স্থানীয় সরকারের জন্য একটি সমন্বিত আইন কাঠামো প্রতিষ্ঠা, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনে নারীর প্রতিনিধিত্বসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব স্থানীয় সরকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। দুঃখজনক হলেও পরে আইনটি সংসদে অনুমোদনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্য থেকে শেষোক্ত দুটি বিষয় বাদ পড়ে যায়।
ড. মজুমদার বাংলাদেশের জনপ্রিয় কলাম লেখকদের একজন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, সমাজ, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি বিষয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করে যাচ্ছেন। তার তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার লেখনী একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার পথ দেখায়। লেখালেখির পাশাপাশি টেলিভিশন ‘টক শো’তে তিনি জনস্বার্থ রক্ষার্থে ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও তিনি একজন গবেষক।
তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। তার ৫০-এরও অধিক গবেষণাপত্র বিভিন্ন খ্যাতনামা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এক ডজনের অধিক। এ ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ ও সাময়িকী। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য সংবলিত তিনটি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তিগত জীবনে বদিউল আলম মজুমদার একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। শিশুকালে তিনি একবার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। ১৯৮৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় নিপতিত হন, এতে তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। ওই দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতরভাবে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
পারিবারিক জীবনে বদিউল আলম মজুমদার দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। বড় ছেলে ড. মাহবুব মজুমদার বাংলাদেশ ‘ম্যাথ অলিম্পিয়াড’ টিমের অবৈতনিক কোচ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে ডা. মাহফুজ মজুমদার যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত। বড় মেয়ে শাহিরা মজুমদার একজন লেখক। তিনি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজ করছেন। মেজো মেয়ে সাবিরা রোজানা মজুমদার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে সামিরা মজুমদার একজন গবেষক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তার স্ত্রী তাজিমা হোসেন মজুমদার একজন স্বেচ্ছাসেবক ও সামাজিক উদ্যোক্তা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার একজন পরিণত বয়স্ক জ্যেষ্ঠ নাগরিক। তার বর্তমান বয়স ৭৭। এ বয়সেও তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ছুটে বেড়ান। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নারীর অগ্রগতি এবং আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রমী উন্নয়ন ধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার সুস্থ ও সাবলীল দীর্ঘ জীবন এবং বাংলাদেশ নাগরিক আন্দোলনে তার অব্যাহত সরব উপস্থিতি কামনা করছি।
ড. তোফায়েল আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ