মিঠে কড়া সংলাপ
দেখ না মন ঝকমারি এ দুনিয়াদারি
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমার আজকের লেখাটির শিরোনাম ফকির লালন সাঁইয়ের বাণী থেকে উদ্ধৃত। লালন ফকির মানবজীবনের দুনিয়াদারিকে ঝকমারি বা ঝামেলাপূর্ণ উল্লেখ করে একটি গান রচনা করেছিলেন। তা ছাড়াও তিনি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে যেসব কথা বলে গিয়েছেন, দেশে-বিদেশে আজও তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া
গ্রামের মলমশাহ নামক এক ব্যক্তি ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দের এক ভোরবেলায় কালীনদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু অবস্থায় বসন্ত রোগাক্রান্ত ১৬-১৭ বয়স্ক এক কিশোরকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে সেবাশুশ্রূষার মাধ্যমে তাকে সারিয়ে তোলেন, তিনিই ফকিরকুলমণি ফকির লালন শাহ। মলমশাহ নিঃসন্তান ছিলেন এবং নদী থেকে উদ্ধার করে সেবাযত্নের পর সুস্থ হয়ে ওঠা লালন ফকিরকে তিনি পুত্রের স্থানে বসিয়ে লালনের ইচ্ছা অনুযায়ী তার বাড়ির একটি খোলা জায়গায় চৌচালা একটি খড়ের ঘর তুলে দিলে দিনরাত সেখানে বসেই লালন দেহতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব এসব নিয়ে গান রচনা করতে থাকেন এবং দিনে দিনে তার ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আর এ সময় তার নাম-পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তিনি শ্লোক বা কবিতার ভাষায় সময়ে সময়ে জবাব দিয়ে বলতেন, ‘সবলোকে কয় লালন কী জাত সংসারে? লালন বলে জাতির বিচার দেখলাম না এই নজরে’! আবার নিজ পরিচয় সম্পর্কে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কী যবন, লালন বলে আমি আমার না জানি সন্ধান’। তাছাড়া জাত-পাত ধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘খতনা দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে হয় কী বিধান, বামন চিনি পৈতা প্রমাণ, বামনি চিনি কী প্রকারে?’
আর এসব কথা দ্বারা সব ধরনের জাত-পাতের ঊর্ধ্বে মানবধর্মকে তথা মানবতাকে তিনি উচ্চস্থানে তুলে ধরেছেন। আবার ধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন ভাব ও ভাষায় বলেছেন, ‘এলাহি আল আলামিন গো আল্লাহ, বাদশা আলামপনা তুমি/ডুবাইলে ভাসাইতে পার, ভাসায়ে কিনার দাও কারও/রাখ মারো হাত তোমার, তাইতে তোমায় ডাকি আমি’। ‘ধন্য ধন্য বলি তারে/বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর/পোস্তা করে’।
মানবমনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ব্যথা-বেদনা সম্পর্কে তার কথাগুলোও সর্বযুগে সর্বক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তিনি বলেছেন, ‘গোয়াল ভরা পুষলে ছেলে/বাবা বলে ডাকে না/মনের দুঃখ মন জানে/সে অন্যে জানে না/মন আর তুমি মানুষ দুইজন/এই দুজনাতেই প্রেম আলাপন/মন আর তুমি একজন হলে/অনায়াসে অমূল্য ধন মেলে’। ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না/নড়েচড়ে হাতের কাছে/খুঁজলে জনম ভর মেলে না’। ‘খেয়েছি বেজাতে কচু না বুঝে/এখন তেঁতুল কোথা পাই খুঁজে’।
উপরের সামান্য কয়েকটি লাইনের কয়টি কথা পর্যালোচনা করলেই অনায়াসে বোঝা যায়, লালন ফকির সামান্য কোনো ব্যক্তি ছিলেন না; তিনি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। অক্ষরজ্ঞানহীন একজন বাউল সাধক, একজন বাউল ফকির হিসাবে তিনি বাউল সংগীত রচনায় যে প্রখর জ্ঞান ও মেধার পরিচয় রেখে গিয়েছেন, বাংলাসাহিত্যেকেও তা সমৃদ্ধ করেছে।
বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে লালন ফকির যেসব কথাবার্তা বলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও তিনি যে একেশ্বরবাদী ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন-‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে/ক্ষম হে অপরাধ আমার/এ ভবকারাগারে’। ‘এসো হে অপারের কান্ডারী/পড়েছি অকূল পাথারে/দাও আমায় চরণতরী’। ‘এসো দয়াল পার করো এই ভবের ঘাটে/ভবনদীর তুফান দেখে/ভয়ে প্রাণ কেঁপে ওঠে’। পাড়ে লয়ে যাও আমায়/আমি অপার হয়ে বসে আছি/ওহে দয়াময়’।
উল্লেখ্য, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া লালন ফকিরের আখড়ার অনতিদূরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি এবং লালন ফকিরের মৃত্যুর সময় থেকে কবিগুরু শিলাইদহে বসবাস শুরু করে একনাগাড়ে প্রায় বারো বছর সেখানে অবস্থান করে কাব্যচর্চা করেন। সে অবস্থায়, অনেকে বলেন বা মনে করেন যে, লালন শাহের বাউল গান বা তার রচিত কাব্যের ভাবধারা রবীন্দ্রনাথের কিছু কাব্য রচনার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। যেমন কবিগুরুর লেখা, ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’। কিন্তু রবিঠাকুরের সোনার তরী কবিতার সঙ্গে লালন ফকিরের দু-একটি কাব্যকথার অন্তর্নিহিত ভাবের মিল থাকলেও কবিগুরু লালন ফকিরের চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনটি মনে করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। যদিও অনেকে বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের কাব্যকথার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমি মনে করি, যেহেতু লালন ফকিরের আখড়া এবং কবিগুরুর কুঠিবাড়ির অবস্থান অনেকটা কাছাকাছি, তাই বিষয়টিকে অনুমাননির্ভরভাবে কেউ কেউ মেলানোর চেষ্টা করেন। যা হোক, আমার কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকায় এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।
আমার জন্মস্থান পাবনা শহরের দক্ষিণাংশের বাজিতপুর ঘাট থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি এবং লালন ফকিরের আখড়া দুটিই নিকটবর্তী। পদ্মা নদীর উত্তরপাড়ে আমার জন্মভিটা আর পদ্মার দক্ষিণে পাশঘেঁষে কুঠীবাড়ি এবং লালনের মাজার। সে অবস্থায়, হাইস্কুলে পড়া অবস্থাতেই কুঠিবাড়ি এবং আখড়ায় আমার যাতায়াত ছিল। পরবর্তীকালে সরকারি চাকরির সুবাদে আমার প্রথম পোস্টিং ছিল কুষ্টিয়ায়। আর তখন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ছিলেন আবুল হাসনাত মোফাজ্জল করিম; যিনি একজন লালনভক্ত ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। এমনকি বাউল গানের সাধক হিসাবে তিনি তার চুলও বড় করে রেখেছিলেন। তো সে সময়ে আমরা যারা জেলা পর্যায়ে তরুণ অফিসার ছিলাম, তাদের অনেকেই সপ্তাহে অন্তত একদিন লালন শাহের মাজারে গান শুনতে যেতাম। বিকাল বেলায় সেখানে গেলে বাউল ফকিরদের জমে ওঠা আড্ডা দেখে আমরাও সেই আড্ডায় মেতে উঠতাম।
অতঃপর আজ প্রায় ৫০ বছর পর হঠাৎ করে সেখানে যাওয়া হবে, তা ভাবিনি। আমার এক ভাগ্নে বর্তমানে ডাক বিভাগের পাবনা অফিসের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল। তো ক’দিন আগে সে এসে বলল, ‘মামা চলেন, একদিন লালন শাহের আখড়ায় (মাজারে) গিয়ে গান শুনে আসি।’ মহামান্য রাষ্ট্রপতির পাবনা আগমন উপলক্ষ্যে আমি এখানে এসেছিলাম এবং তিনি ফিরে যাওয়ার পর পাবনার বাড়িতে একরকম বসেই ছিলাম।
সুতরাং ভাগ্নের কথায় রাজি না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। বাজিতপুর শ্রমজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আকুব্বার রহমানকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তিনজন পাবনা থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে রওয়ানা হলাম এবং এক ঘণ্টায় সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম। বিকাল ৫টায় সেখানে আমরা হাজির হলে ভাগ্নে আনোয়ারকে দেখে ফকিরকুলের শিল্পীরা এগিয়ে এলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন বয়সি লালনশিল্পী ও দর্শক-শ্রোতায় স্থানটি গমগম করে উঠল। আমাদের কয়েকজনের জন্য কয়েকটি চেয়ার এনে দিলে আমরা সেখানে বসে পড়লাম এবং সেই সঙ্গে ঢোল-তবলা-একতারা ইত্যাদি নিয়ে শিল্পীরাও গানের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। প্রথমেই একজন জ্যেষ্ঠ শিল্পী গান গাইলেন; তারপর একের পর এক বেশ কয়েকজন।
এক পর্যায়ে বিশিষ্ট ফোকলোর শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করে দিলে আমরা বিভোর হয়ে তার গাওয়া একটি লালনগীতি শুনলাম। একজন কিশোরীর গাওয়া দুটি গান শুনেও মুগ্ধ হলাম। এভাবে মাগরিব নামাজের সময় ঘনিয়ে আসায় গান বন্ধ হলো, আর আমরাও উঠে দাঁড়িয়ে গোধূলিলগ্নে চার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাবরি চুলধারী আরও অনেক লালনশিল্পী ও ভক্ত ততক্ষণে এলাকাটিতে জড়ো হয়েছেন। মাজারের বিপরীত দিকের লালন চত্বরে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে; ফুচকা, চটপটির দোকানগুলোও জমে উঠেছে।
চারদিকে তাকিয়ে আগত লোকজনের চোখে-মুখে খুশির ভাব লক্ষ করলাম। সেখানকার শিল্পীদের মুখেও সুখের আভা দেখতে পেলাম। আর সে সুখ ধনসম্পদ বা পদবীর সুখ নয়। পার্থিব কোনো কিছুর আশা বা প্রাপ্তি ছাড়াই সবার চোখে-মুখে এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ ছিল; সবার চোখই যেন হাসিতে ভরা ছিল। এ যেন গানের কথার মতোই, ‘শুধু দুটি আঁখি ভরে রাখি হাসিতে’। অথচ আমরা দিনরাত প্রাপ্তির হাসি হাসতে চাই। সেদিন সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে আমি নিজেকে মেলাতে গিয়ে যেন লজ্জাই পেলাম! কারণ প্রায় ৫০ বছর পর সেখানে গিয়ে লালনশিল্পী এবং আশপাশের লোকদের চোখে-মুখে যে দৃশ্য দেখে ফিরলাম; সে দৃশ্য অত্যন্ত নির্মোহ, অত্যন্ত নিঃস্বার্থ।
অথচ এ পঞ্চাশ বছরে আমি নিজে কত কিছুই না চেয়েছি। পদপদবিসহ অর্থ-বিত্ত লাভ করতে ঘামঝরানো পরিশ্রমের পাশাপাশি দৌড়াদৌড়িও কম করিনি। এইমাত্র কয়দিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পাবনা সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের জন্য আমিও ঢাকা থেকে দৌড়ে চলে এসেছিলাম; আর এ বিষয়টিও সম্পূর্ণ নির্মোহ ছিল, তেমনটি নয়। কারণ, আমি বা আমরা প্রায় সবাই কিছু না কিছু পার্থিব প্রাপ্তির পেছনেই ছুটে বেড়াই। আর সেসব প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হলে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়। কথাটি এখানে উল্লেখ করার বিশেষ কারণ হলো, সেদিন লালন ফকিরের আখড়ায় গিয়ে সেখানকার মানুষের চেহারায় যে নির্মোহ ভাব দেখেছি, সে বিষয়টি আমার মনে প্রভাব বিস্তার করেছে।
কারণ, আমার জন্মভিটার অদূরেই সেদিন কিছু মানুষকে দেখে এলাম, যাদের চোখে-মুখে লোভ-লালসা, চাওয়া পাওয়ার লেশমাত্র নেই। আপনারে চিনতে তারা যে কতটা সহজ-সরল পথ বেছে নিয়েছেন, তাদের সান্নিধ্যে গেলে সে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। সেদিন তাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে মনে হলো, তারা কত খুশি! আর সে তুলনায় আমি বা আমাদের মতো মানুষ কতটা দুঃখী। কারণ, আমরা সবসময় পার্থিব প্রাপ্তির পেছনে ছুটে বেড়াই!
আর সে কারণে অনেক সময় আমাদের ঝুটঝামেলাও পোহাতে হয়; যেমনটি লালন ফকির বলে গেছেন, ‘দেখ না মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারি’! এ অবস্থায়, আমরা যদি লোভ-লালসা থেকে নিজেদের মুক্ত করে সৎচিন্তা ও সদাচরণের মাধ্যমে হানাহানিমুক্ত নির্মোহ জীবনাচারে অভ্যস্ত হই, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠবে; আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা এবং পরিবেশ দেশের মানুষের জন্য সুখময় হবে, কল্যাণময় হবে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট