সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ণ ঘটাতে হবে
মোহাম্মদ মুজাহেদ হোসেন চৌধুরী ও এসএম আবু নাহিয়ান মিঞা
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২৪ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের স্থায়ী আদেশবলে চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের পথ খুলে গেল ভারতের।
২০১৮ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘এগ্রিমেন্ট অন দি ইউজ অফ চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্টস ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। সেই চুক্তির স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর সই হয় ২০১৯ সালে। এরপর প্রথম ‘ট্রায়াল রান’ হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। অতঃপর ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট বিধিমালা জারি হয় ২০২১ সালে।
এসবের আলোকে ২৪ এপ্রিল স্থায়ী আদেশ জারি হওয়ার পরই বাংলাদেশের জনমনে কিছুটা হলেও সমালোচনার গুঞ্জন উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদৌ বাংলাদেশের জন্য এমন চুক্তি করাটা কি যুক্তিযুক্ত? লাভ-ক্ষতির অঙ্কে পাল্লাটা কার দিকে ঝুঁকছে? এ অবস্থায় আসলে বাংলাদেশের করণীয় কী?
এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগে ট্রানজিট ও ট্র্রান্সশিপমেন্টের পার্থক্যটা জানা থাকা প্রয়োজন। রিভাইজড কিয়োটো কনভেনশন অনুসারে, একটি অঞ্চলের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহণের জন্য যদি আদি পরিবহণ মাধ্যমটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে তাকে বলে ট্রানজিট। অপর দিকে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভেতর দিয়ে পরিবহণ করতে যদি পণ্য আনলোড করে নতুন মাধ্যমে লোড করতে হয়, তবে তা ট্রান্সশিপমেন্ট। যেমন-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পণ্য যদি ভারতীয় ট্রাকের সাহায্যেই পরিবহণ করা হয় তবে তা হবে ট্রানজিট। আর বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পণ্যগুলো আনলোড করে বাংলাদেশি ট্রাকে লোড করে পরিবহণ করলে তা হবে ট্রান্সশিপমেন্ট। শিপিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্টের ভিন্ন সংজ্ঞা থাকলেও ভারত-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এ সংজ্ঞাই কার্যকর। কারণ, চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দরে পণ্য খালাসের পর তা সীমান্ত অবধি পৌঁছানোর দায়িত্ব থাকবে বাংলাদেশি পরিবহণ মাধ্যমের। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিলিগুড়ি করিডর হয়ে সেভেন সিস্টারস খ্যাত ৭টি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। আসাম থেকে চিকেন’স নেক হয়ে কলকাতা বন্দরের দূরত্ব প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে যা ১৬৪৫ কিলোমিটার। অপর দিকে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৭৬ কিলোমিটার। তাই স্বভাবতই ভারতের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারাটা এক সুবর্ণ সুযোগ।
এ অবস্থায় এমন প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে, নিজ দেশের বন্দর অপর দেশকে ব্যবহার করতে দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়ে এমন নজির কম নেই। বিশেষত সিঙ্গাপুরের আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল তাদের বন্দর ও ট্রান্সশিপমেন্ট সেবার যথাযথ ব্যবহার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও একটি ট্রান্সপোর্ট/লজিস্টিকস হাব হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে, এ অঞ্চলে ভারত, নেপাল ও ভুটানই বাংলাদেশের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সেবার প্রাথমিক বাজার। বিশেষত ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি সেবা ও পণ্যের বাজারকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ, শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণে যে বিশাল ব্যয়, তা দিনশেষে বহন করতে হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ভোক্তাদেরই। তাই এসব রাজ্যের কাছে চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের সুযোগ লোভনীয় বটেই। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভের সমীকরণ কষতে গেলে দেখতে হবে ভারতীয় পণ্যের হ্যান্ডেলিং এবং পরিবহণের জন্য কতটুকু মাশুল নিচ্ছে বাংলাদেশ। এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, প্রতি চালানের ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টন পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা ও অন্যান্য প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা। নিরাপত্তার জন্য এসকর্ট চার্জ প্রতি ট্রাক/কনটেইনারের জন্য ৮৫ টাকা। এক্সরের সাহায্যে কনটেইনার প্রতি স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা। সড়কপথে প্রতি টন পণ্য প্রতি কিলোমিটার পরিবহণ করতে ফি ১.৮৫ টাকা। ইলেকট্রিক লক/সিল ফি নির্ধারিত হবে বিধিমালা অনুসারে।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়, ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে দেশের ভেতর পরিবহণের দায়িত্ব শুধু দেশীয় প্রতিষ্ঠানই নিতে পারে। অর্থাৎ ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশি বন্দর থেকে মুক্ত হওয়ার পর তা ভারতীয় বর্ডার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশি ট্রাকারদের। এক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ট্রায়াল থেকে। ১২৫ কনটেইনারের কনসাইনমেন্ট চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিলেটের শেওলা পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি ট্রেইলারের ভাড়া ছিল ৮০ হাজার টাকা (টিবিএস, ২০২২)। ফিরতি পথে ডাউকি থেকে কনটেইনারগুলোতে মেঘালয়ের চা পাতা পাঠানো হয়। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়, বন্দর এবং কাস্টমসের মাশুল সরকারি খাতে যুক্ত হলেও পণ্য পরিবহণের ভাড়া যুক্ত হয়েছে বেসরকারি খাতে। একই সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি করারও একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে স্বল্প অথবা বিনা মাশুলে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি নিশ্চিত করার দায়িত্ব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের। সর্বোপরি, চট্টগ্রাম ও মোংলা থেকে ভারতে পণ্য পরিবহণের জন্য মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। আর সেই নেটওয়ার্কের সুবিধা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নেওয়াটা একান্তই কাম্য।
তবে এ ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের প্রধান পরিবহণ মাধ্যম হওয়া উচিত রেল। কারণ, বিশ্বজুড়েই নিরাপদে ও কম খরচে পণ্য পরিবহণের জন্য রেল হচ্ছে সবচেয়ে টেকসই মাধ্যম। এমনকি আলোচ্য দেশ ভারতেও রয়েছে দুটি ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর; যা মূলত পণ্য পরিবহণের জন্য বিশেষ রেলপথ। ভারত-বাংলাদেশের এ চুক্তি হওয়ার পরে অনেকেই নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশি আইনে নিষিদ্ধ এমন পণ্য পরিবহণ এ চুক্তিতে নিষিদ্ধ। কিন্তু তবুও বিপজ্জনক পণ্য চোরাচালানের আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে রেলওয়ে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের ওজন নীতিমালা। বাংলাদেশের সড়ক সংযোগ এক্সেল প্রতি সর্বোচ্চ ৮.২ টন ওজন নিতে সক্ষম। অপর দিকে ভারত, ভুটান ও নেপালের ক্ষেত্রে তা ১০.২ টন। এ ছাড়া বন্দর থেকে আসা ট্রাক ও ট্রেইলারগুলো অত্যন্ত ভারী হওয়ায় এদের অবাধ চলাচলে নিশ্চিতভাবে সড়কপথের ক্ষতি হবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান হলো রেলপথে মালামাল পরিবহণ করা। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম-আখাউড়া-শাহবাজপুর/মহিশ্মশান রেল সংযোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (রহমতউল্লাহ, ২০০৯)। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ এবং কুলাউড়া-মহিশ্মশান রেল সংযোগ অবাধ হলে পণ্য পরিবহণের পথ সুগম হবে। আর দীর্ঘ পথে বৃহৎ পরিমাণ পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহণের তুলনায় রেল পরিবহণ বেশি সাশ্রয়ী। একই সঙ্গে তা পরিবেশের জন্য বেশি নিরাপদও বটে। তাই পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সড়কপথের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রেলপথকে উন্নত করা এখন সময়ের দাবি।
মোহাম্মদ মুজাহেদ হোসেন চৌধুরী : সহকারী অধ্যাপক, পোর্ট অ্যান্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া
এস এম আবু নাহিয়ান মিঞা : গবেষণা সহকারী