কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেকারত্ব বাড়াবে
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিজ্ঞানের ঈর্ষণীয় সাফল্যের নতুন উদ্ভাবন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এআই)। প্রতিনিয়ত এর ছোট বড় ব্যবহার মানুষের জীবনকে যেমন করছে সহজ, সুন্দর ও সাবলীল, তেমনি করছে জটিল ও বিপজ্জনক।
তথ্যপ্রযুক্তির এ ব্যবস্থা মানুষের মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আবেগ-অনুভূতি, সিদ্ধান্ত সবই বুঝতে পারে এবং মানুষের বুদ্ধিমত্তার মতোই কাজ করে। বিগত কয়েক বছর ধরেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপট চলছে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেজ প্রফেসর এমি ওয়েবের মতে, ইতিবাচকভাবে চিন্তা করলে এআই’র রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা।
তবে এআই’র উন্নতির জন্য সিস্টেম ডিজাইনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও তথ্যের ইনপুটের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রাইভেসিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এআই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ঠিক কোন দিকে যাবে সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে তাদের ওপর।’ তিনি মনে করেন, প্রতিটি দেশের ও প্রতিষ্ঠানের উচিত প্রযুক্তিটির অপব্যবহার রোধে দ্রুত আইন ও নীতিমালা তৈরি করা।
ফিউচার টুডে ইনস্টিটিউটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেলানি সুবিন বলেন, ‘এআই প্রযুক্তির রক্ষণাবেক্ষণে যে নীতিমালা দরকার, সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই। স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে ইলন মাস্ক-বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন বিজ্ঞানী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এটি একসময় হয়তো মানব প্রজাতির জন্য একটি হুমকি হয়ে উঠবে, বিরূপ প্রভাব ফেলবে জাতীয় অর্থনীতিতে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক বিশ্লেষণমূলক ক্ষমতা মানুষকে বেকারত্বের সংকটে ফেলবে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে মানুষের তুলনায় এআই কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সময় বাঁচাতে পারে। ফলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রেই গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ চাকরিজীবীর অন্তত ১০ শতাংশ কাজ দখল করবে এআই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ চাকরিজীবীর প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ এ প্রযুক্তিটি দখল করে ফেলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১৫টি পেশায় চাকরির বাজার উল্লেখযোগ্য হারে দখল করতে পারবে এআই।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-গণিতবিদ, ট্যাক্স প্রস্তুতকারী, লেখক, ওয়েব ডিজাইনার মতো পেশা। এ তালিকার এর পরই আছে হিসাবরক্ষক, সাংবাদিক, আইন সচিব, ক্লিনিক্যাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। আবার শতভাগ না হলেও ল্যাংগুয়েজ মডেল টাইপের এআই প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত চাকরির বাজার দখল করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ব্লকচেইন ইঞ্জিনিয়ার, প্রুফ রিডার, কপি মার্কারের মতো পেশা। ফলে যুক্তরাষ্ট্র্রের প্রায় ৩০ কোটি ফুলটাইম চাকরির বাজার এআই’র দখলে যাবে (গোল্ডম্যান স্যাকস রিপোর্ট)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক ইয়ান গোল্ডিনের বিবিসির এক প্রতিবেদন বলেছে, ইউরোপে আগামী দশকে ৪০ শতাংশ চাকরি চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে এবং এর প্রভাবে আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে, এআইসমৃদ্ধ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জেরে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের পাঁচটি খাতে (তৈরি পোশাক, আসবাব তৈরি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন ও চামড়াশিল্প) প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ কাজ হারাবেন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের ৬০ শতাংশ এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ৪০ শতাংশ শ্রমিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে বেকার হবেন। বিশ্বের অনেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চালকবিহীন গাড়ি চালানোর প্রযুক্তি পুরোদমে বাজারে ছাড়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। এর ফলে অনেক গাড়িচালক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে সতর্ক করেছেন চ্যাট জিপিটির উদ্ভাবক ও ওপেন এআই’র প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান এবং বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ কেড়ে নিতে পারে, গুজব ছড়াতে পারে, এমনকি নিজের ইচ্ছায় সাইবার আক্রমণ পর্যন্ত করতে পারে। তাই দিন দিন এ প্রযুক্তির বিকাশকে ধীরগতি করার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। যদিও সুবিধার বিবেচনায় দিন দিনই এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে ভবিষ্যতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৪০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ৫০ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।
নিত্যব্যবহার্য স্মার্টফোনের স্মার্ট অ্যাসিসট্যান্টও (Google Assistant, Siri, Bixby) এআই প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আঙুলের স্পর্শ ছাড়াই ভয়েসের মাধ্যমে ইচ্ছামতো অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করা যায়। এছাড়াও সাম্প্রতিক চালকবিহীন গাড়িতে ব্যবহৃত ‘অটো পাইলট’ ব্যাপারটাও সম্পূর্ণ এআই। বর্তমানে শিল্প-কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতিতেও এআই ইমপ্লান্ট করা হচ্ছে। অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফ্ট, আলিবাবা, অ্যাপল ইত্যাদি বড় বড় সব টেক জায়ান্টও প্রচুর পরিমাণে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং এর সম্ভাব্য সব সংস্করণ ও উন্নতি করছে। এ হিসাবে বলা যায়, ভবিষ্যৎ পৃথিবী অবশ্যই এআইনির্ভর হবে এবং এই প্রযুক্তি কতটা নিরাপদ হবে তা নির্ভর করছে আমাদের চিন্তাধারা ও এর ব্যবহারের ওপর।
তবে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণেই বেকারত্ব বাড়ছে, এমনটিই নয়। নতুন এ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারাটাও এজন্য অনেকটা দায়ী। তাই আগামী দিনগুলোয় আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে, নতুন প্রযুক্তি উপযোগী পরিবেশ ও প্রস্তুতি তৈরি করে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। পাশাপাশি এর পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা ও ক্ষমতা নিয়ে সচেতন থাকা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়েই হয়তো ভবিষ্যতে কল সেন্টার এবং পোশাক কারখানার মতো কাজগুলো নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে এসব কাজে নিয়োজিত মধ্যম ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর লাখ লাখ কর্মী যে কর্মহীন হয়ে পড়বে, তার লক্ষণ এখন আমাদের চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। কাজেই ভবিষ্যতে হয়তো ক্লিনার কিংবা কলকারখানায় শ্রমিক লাগবে না; কিন্তু ক্লিনিং ও শিল্পের যন্ত্র তৈরি, উন্নয়নে ও অপারেশনে দক্ষ জনশক্তি লাগবে। এছাড়া মালির কাজ, কুরিয়ার ডেলিভারির কাজ, গৃহস্থালি কাজগুলো ভবিষ্যতে যে এআই যুক্ত রোবটই করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নত দেশে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এআই দিয়ে। আবহাওয়া কেমন থাকবে, বৃষ্টি, গরম নাকি ঠান্ডা-এমন এক সপ্তাহের আগাম বার্তা সার্বক্ষণিক প্রচার করা হয় গণপরিবহণে সংযুক্ত টিভি মনিটরে। এভাবে আগামী দশকের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অপরিহার্য অংশ হিসাবে আবির্ভূত হবে যে এআই’র ব্যবহার ছাড়া আমরা একদিনও হয়তো চলতে পারব না। স্বাস্থ্যসেবা, জটিল অস্ত্রোপচার কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল সিদ্ধান্ত দেওয়া, শিল্পদ্রব্যের ডিজাইন ও উৎপাদন, গ্রাহকসেবা, ব্যাংকিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই নতুন প্রযুক্তি হয়ে উঠবে সুস্পষ্ট ও সর্বব্যাপী। তাই ভবিষ্যতে বেকারত্বের লাগাম টানতে এসব কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সৃজনশীল, নান্দনিক এবং জাতীয় সুরক্ষার উপযোগী করার লক্ষ্যে কী ধরনের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, প্রস্তুতি ও অবকাঠামো দরকার, তা নিরূপণ করার এখনই সময়।
সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও ব্যবসাবান্ধব উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই এআই’র সঠিক উদ্ভাবন, ব্যবহার এবং সময়োপযোগী উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; তথ্যপ্রযুক্তিবিদ