Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

এমন নমনীয় আইন দিয়ে বখাটে দমন হবে না

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এমন নমনীয় আইন দিয়ে বখাটে দমন হবে না

অবশেষে মেধাবী স্কুলছাত্রী মুক্তি বর্মণকে এক বখাটের দায়ের কোপে প্রাণ দিতে হলো। মুক্তিকে বখাটে কাওছার দীর্ঘদিন থেকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছে কয়েকবার। মেয়েটি বখাটের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় কাওছার পরিকল্পিতভাবে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে মুক্তিকে হত্যা করে।

ঘটনাটি ঘটে ২ মে নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায়। স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ১৫ বছর বয়সি মুক্তি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হিসাবে মুক্তি ছিল পরিচিত। মুক্তি সেদিন দুপুরে সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল। পথের মধ্যে একস্থানে বখাটে কাওছার ধারালো দা নিয়ে মুক্তিকে আক্রমণ করে। মেয়েটির মাথা ও ঘাড়ে পরপর পাঁচটি কোপ দিয়ে ঘটনাস্থলেই দা ফেলে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় মুক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হত্যাকারীকে পুলিশ পরদিন গ্রেফতার করে। সে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে এখন জেলহাজতে।

স্কুলছাত্রী মুক্তি বর্মণের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যাকারী বখাটে কাওছারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নেত্রকোনা, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার নেত্রকোনা শহরসহ জেলার তিন স্থানে এবং ঢাকায় শাহবাগ চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি এখনো চলছে বিভিন্ন জেলায়। সবখানে প্রধান দাবি একটিই-অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

বিচারের দাবিতে রাস্তায় কেন

আমাদের সবার জন্য বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, একটি হত্যাকাণ্ড বা অপরাধ সংঘটিত হলে জনগণকে অপরাধীর শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়। অপরাধ যখন ঘটে, তখন অপরাধীকে গ্রেফতার ও উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রের দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে রাখা হয়েছে এ উদ্দেশ্যেই। তাদের কাছে দাবি জানাতে হবে কেন? পুলিশের দায়িত্ব পুলিশকে পালন করতেই হবে। দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ রয়েছে। পুলিশ যদি কালক্ষেপণ না করে সময়মতো অপরাধের নির্ভুল তদন্ত করে আদালতে দ্রুত চার্জশিট জমা দেয়, তাহলে অপরাধের বিচার হবে। অপরাধীও উপযুক্ত শাস্তি পাবে। এটাই সবার কাম্য।

চার্জশিট দুর্বল কেন

কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? জনগণের আশা পূরণ হচ্ছে কি? হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ড বা ধর্ষণের মতো বড় অপরাধ সংঘটিত হয়, কিন্তু অপরাধী সহজে ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও পুলিশ তদন্তে ও চার্জশিট দিতে দীর্ঘ সময় নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চার্জশিট থাকে দুর্বল, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয় না। এর সুবিধা পায় অপরাধী। সে খালাস পেয়ে যায়। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় ভুক্তভোগী বা বিচারপ্রার্থী।

হত্যাকাণ্ড-ধর্ষণ ইত্যাদি বড় অপরাধের ক্ষেত্রে যদি দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যেত, অপরাধীকে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে অপরাধীরা ভয় পেত, দেশে অপরাধ নিশ্চিতভাবেই কমে যেত। পুলিশের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণেই উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত হয় না বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল মনে করে। দুর্বল চার্জশিটের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামি খালাস পেয়ে যায়। চার্জশিট কেন দুর্বল হয় সেটা সহজেই বোধগম্য। বিচারহীনতার কারণেই ভুক্তভোগী জনগণকে রাস্তায় নামতে হয়। দাবি জানাতে হয় ন্যায়বিচারের জন্য।

অপ্রতিরোধ্য বখাটে, কিশোর গ্যাং

নেত্রকোনায় মুক্তি বর্মণের হত্যাকাণ্ডকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে গণ্য করা ঠিক হবে না। বেশ কয়েক বছর ধরে সারা দেশে বখাটেদের যে উপদ্রব চলছে, এ ঘটনা তারই অংশ মাত্র। বখাটেরা ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব জেলা শহর এবং উপজেলার শহরাঞ্চলে তারা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বখাটে তরুণদের প্রধান অপকর্ম হচ্ছে রাস্তায় স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা। এদের উপদ্রবের কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে ভয় পান। নিরাপত্তার প্রয়োজনে মেয়েরা দলবেঁধে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। তারপরও রেহাই পাওয়া যায় না। যেমন নেত্রকোনার মুক্তি বখাটের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি।

তথাকথিত ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্য বখাটেরা এখন সব ধরনের অপকর্ম ও অপরাধ করতে শিখেছে। এলাকার দোকানপাট, বাজারে বখাটেদের চাঁদাবাজি এখন সাধারণ ব্যাপার। মাদক ব্যবসায়ীরা বখাটেদের মাদক পাচারে ব্যবহার করে। এসব করতে গিয়ে কিশোর-তরুণরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং আরও বেশি অপরাধ করে। এলাকার ‘বড়ভাই’রা অসৎ উদ্দেশ্যে বখাটেদের ব্যবহার করে, এতে তাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। কারণ, বড়ভাইরাই তো বখাটেদের প্রটেকশন দেয়। বখাটেদের পুলিশ মাঝেমধ্যে ধরলেও বড়ভাইরা জামিনের ব্যবস্থা করে। জামিনে মুক্ত হয়েই তারা আবার অপরাধ জগতে ফিরে যায়। বখাটে দমনের কোনো উদ্যোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আছে কিনা জানি না, কারণ আমরা তাদের তৎপরতা দেখি না।

আইন বদলাতে হবে

বখাটে বা কিশোর অপরাধীদের দমনের আইন দেশে রয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের এ ‘শিশু-কিশোর অপরাধ আইন’ এখন যুগোপযোগী নয়। এ আইন অনুযায়ী অপরাধীর বয়স যদি ১৮ বছরের কম হয়, তাহলে তাকে ‘শিশু-কিশোর’ বলে গণ্য করা হবে, শাস্তিও হবে লঘু বা নমনীয়। শিশু-কিশোর হিসাবে চিহ্নিত বখাটেরা যে অপরাধই করুক না কেন, শাস্তির জন্য তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে পাঠানো হয় সংশোধনাগারে। সেখানে তারা জামাই আদরে আরামে থাকে। মেয়াদ শেষে সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে তারা আবার অপরাধ করতে থাকে।

এ আইনটি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল গত বছরের জুলাই মাসে। ২০২২ সালের ৩ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে কিশোর অপরাধবিষয়ক আইন পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধায় হয়, দেশের প্রেক্ষাপটে ও বিরাজমান পরিস্থিতিতে আইনটি সংশোধন বা পরিবর্তন করতে হবে। আইন পরিবর্তনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়কে। সরকারের এ উদ্যোগকে সবাই অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আশা করা হয়েছিল, কিশোর অপরাধীর বয়স সর্বোচ্চ ১৮ থেকে কমিয়ে ১৪ বছর করা হবে। তাহলে বয়স কম হওয়ার কারণে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি এড়াতে পারবে না। এক বছর হতে চলল, এখনো জানা যায়নি এ বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে। তাহলে ধরে নিতে হবে, পুরোনো আইনই বলবৎ আছে। হত্যাকারীর বয়স ১৮ বছরের একদিন কম হলেও সে কিশোর বলে গণ্য হবে এবং কঠোর শাস্তি এড়াতে পারবে।

কাওছারের বয়স কত

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে নেত্রকোনার মেয়ে মুক্তির খুনি কাওছারের বয়স ১৮ বছর বলা হয়েছে। তার বয়স ঠিক ১৮ বছর, নাকি কম-বেশি, তা জানা যায়নি। থানায় পুলিশ যে মামলা নিয়েছে এবং চার্জশিটে তার বয়স যা বলা হবে তার ভিত্তিতেই শাস্তি হবে। ১৮ বছরের বেশি হলে তাকে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যাবে। কম হলে তার শাস্তি হবে কিশোর সংশোধনাগার।

এ কারণেই শিশু-কিশোর অপরাধ আইন পরিবর্তন বা সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। অপরাধীর বয়সসীমা ১৮ থেকে ১৪ বছরে নামিয়ে আনলে বখাটেদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম