জাতীয়তার নানা বিন্যাস ও রবীন্দ্রনাথ
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা, অবিভক্ত ও পরাধীন ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে, তার জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার জরুরি ভাবনা নিয়ে গড়ে উঠেছে। এর মূলে একটি তত্ত্ববিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি প্রয়োগের দিক থেকে জাতীয় আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচি নিয়েও তার প্রচুর কথা আছে-যেগুলো আমাদের এখনো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। এ নিয়ে আলোচনাও দেশে-বিদেশে কম হয়নি। শচীন সেন থেকে শুরু করে স্টিফেন হে, নেপাল মজুমদার, অরবিন্দ পোদ্দার প্রমুখ নানা পরিসরে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।
এসব আলোচনা থেকে রসদ নিয়েই আমরা বিষয়টিকে একটু সরলভাবে বুঝতে চাই। এও ঠিক যে, পরাধীনতা বা ঔপনিবেশিকতার সময়ে জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতার চিন্তা যে চরিত্র দাবি করে, দেশ স্বাধীন হলে তার চরিত্র বদলায়, তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যস্ত হয়। এ কথা সবাই জানেন যে, ঔপনিবেশিকতা, জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা-এ তিনটি ধারণা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এ বিষয়টি সব সাধারণ মানুষ হয়তো সমানভাবে অনুভব করেন না। সবার জাতীয়তার চিন্তা, যা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধ, তা অন্য দুটি ধারণাকে সমান গুরুত্ব দেয় না। রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্ববোধ’কেও ওই দুটি ধারণার সঙ্গে সচরাচর যুক্ত করা হয় না, যদিও তা করাই উচিত বলে আমাদের মনে হয়। আমাদের বেশির ভাগ জাতীয়তাবাদ মানবকেন্দ্রিক, মানুষের স্বার্থ এবং ভালো-মন্দই তার বিবেচনার মূলে। শুধু এটুকু হলে মানব-অস্তিত্বের পুরো অর্থ ধরা যায় না। তাই নিছক জাতীয়তা আর মানববদ্ধতাকে অতিক্রম করেই মানুষের অর্থ খোঁজা দরকার, যা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। তার আলোচনার জন্য অনেক বড় পরিসর দরকার, আমরা অন্যত্র তা খুঁজে নেব। এখানে আমরা জাতীয়তার প্রসঙ্গটিকেই একটু বোঝার চেষ্টা করি।
জাতীয়তা : অনুভূমিক আর উল্লম্ব
আপাতত আমরা জাতীয়তা নিয়ে ভাবব। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তার একাধিক মাত্রা (dimensions) আছে। তার একটা দৃষ্টি অনুভূমিক বা horizontal-পাশাপাশি কী আছে, আমাদের জাতীয়তার যে এখনকার উপাদানগুলো রয়েছে তার বিচার। এক্ষেত্রে তার দৃষ্টি সংশ্লেষণাত্মক, তার মতে অনেক অন্তর্গত ও বহিরাগত উপাদান, গোষ্ঠীসত্তা মিলিত হয়ে এক অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তার সৃষ্টি হয়েছে। গীতাঞ্জলির কবিতায় (পরে ‘ভারত-তীর্থ’ নামে পরিচিত) ওই পঙক্তিগুলো সবারই পরিচিত-‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চিন; শক-হুনদল, পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ তিনি যখন ভারতের ইতিহাস বিচার করেন, তখন এই উপাদানগুলো কীভাবে একসঙ্গে হলো, কীভাবে পরস্পরের মিলনে এক বহু জাতি (নৃগোষ্ঠী), বহু সম্প্রদায়, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির অখণ্ড ও সংহত ভারত গড়ে তুলল, তার ধারাটি দেখান। ‘এক দেহে লীন’ বা মিলন মানে সবার ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ছেড়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো এক ভাষায়-পোশাকে নতুন ইউরোপীয়করণের মতো কিছু নয়, কিন্তু মূলত এ দেশে এসে, এ দেশকে বাসভূমি হিসাবে স্বীকার করে তার অধিবাসী হয়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ এই ‘মিলন’কেই বা জাতীয়তার নির্মাণকেই একটি ‘সাধনা’ হিসাবে দেখেন-যে সাধনা হয়তো লেনিন বা মাও জে দংয়ের ‘বিপ্লব’র মতোই-কখনো শেষ হয় না, নিরবধিকাল চলতেই থাকে। ‘ভারত-ইতিহাস-চর্চা’ নামে একটি স্বল্পদৃষ্ট প্রবন্ধেও তার সিদ্ধান্ত-‘প্রত্যেক জাতির সমস্যা সেখানেই, যেখানে তাহার অসামঞ্জস্য। যাহারা বাহিরে পাশাপাশি আছে, অন্তরে তাহাদিগকে মিলিতেই হইবে। এই মিলন-চেষ্টাই মানুষের ধর্ম, এই মিলনেই মানুষের সকল দিক দিয়া কল্যাণ। সভ্যতাই এই মিলন।’ রবীন্দ্রনাথ ‘মিলন’ আর ‘একাকারত্বে’র মধ্যে তফাত দেখান। মিলন হলো প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য ও সম্মান বজায় রেখে সমানাধিকারের ভিত্তিতে এক হওয়া, আর ‘একাকার’ হয় কোনো যান্ত্রিক কারণে, আধিপত্যের চাপে, ফ্যাসিবাদের আরোপে। তাতে কারও স্বাতন্ত্র্য আর সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যের সম্মান রক্ষিত হয় না। ভারতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের-হিন্দু-মুসলমান-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের, এবং সেই সঙ্গে নাগরিক, গ্রামীণ, আর একদা বা এখনো অরণ্যচারী আদিবাসীদের অবস্থান। এক মহাজাতির সমমর্যাদাভুক্ত সদস্য হিসাবে ‘মিলন’র এই জাতীয়তা-নির্মাণ, ‘এক দেহে লীন হওয়া’-যা কেবল গণতন্ত্রের আশ্রয়েই ঘটতে পারে, তা-ই রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল।
উপরের কথাগুলো এবং তার নানা রাজনৈতিক প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ইত্যাদি থেকে বোঝা যায়, কবিতায় এক দেহে লীন হওয়াকে রবীন্দ্রনাথ যতটা finality বা চূড়ান্ত পরিণাম হিসাবে উচ্চারণ করেছেন, গদ্যে তার সমস্যাবলি সম্বন্ধে তিনি কম সচেতন নন। কারণ এ প্রক্রিয়াটি যেন অন্তহীন। ‘ভারত-তীর্থ’ কবিতায় ইতিহাসের যে পরম্পরা ব্যাখ্যাত হয়েছে, তাতে দুটি ভাঁজ বা পর্ব আছে। একটা পর্যায়ে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর একীকরণ ঘটেছে, তার সবাই একটা সময়ে ‘এক দেহে হল লীন’। কিন্তু সেই ‘লীনতা’ চূড়ান্ত নয়, ভারতে আবার নতুন করে ‘লীন’ হওয়ার সাধনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ‘ভারত-তীর্থ’ কবিতাতেও সেই ইঙ্গিত আছে; নইলে এর শেষে একটা আহ্বান থাকত না-‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান; এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।’ দেখাই যাচ্ছে, তার স্বীকৃতি-‘মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা।’ ফলে আমাদের জাতীয়তার নির্মাণ এখনো যে অসম্পূর্ণ, তা ভিন্সেন্ট স্মিথের Unity in diversity বা অতুলপ্রসাদীয় বিবিধের মাঝে মিলনের উচ্ছ্বাসকে Unity in কিছুটা অতিকথনের যে চরিত্র দেয়, সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ অনেকের চেয়েই বেশি সচেতন ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র আর সমাজের সংগঠনে ভারতে (এবং অন্যান্য দেশেও) বিভিন্নতার একটা ‘উল্লম্ব’ বা উঁচু-নিচুর দিক আছে। ‘বাহিরে পাশাপাশি’ থাকাটাই একমাত্র সমস্যা নয়। পাশাপাশি আছে, আবার তাদেরই মধ্যে একটা উঁচু-নিচুর বিন্যাস, হয়তো ঐতিহাসিক কারণেই। কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং সে কারণে রাষ্ট্রক্ষমতার মূল রাশটা তাদের হাতে, ফলে তারা বেশি অধিকার ও অহমিকা ভোগ করে। কেউ শিক্ষা আর অর্থনীতিতে পশ্চাৎপদ, ফলে তাদের অধিকার সংকুচিত। এই পাশাপাশি থাকাও তাদের এক অসম উচ্চ-নিচ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু দুটিই এ অনুভূমিক বা ‘পাশাপাশি’ ধারণা, কিন্তু তার একটা উচ্চ-নিচতার মাত্রাও আছে। সেটা যেমন ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের তুলনামূলক ক্ষমতার বিন্যাসে আছে, তেমনি সম্প্রদায়গুলোর নিজেদের মধ্যেও আছে। তারও কারণ ঐতিহাসিক। সামন্ততন্ত্রে তার উদ্ভব, উপনিবেশে আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে তা কিঞ্চিৎ ধাক্কা খেয়েছিল। সাধারণ শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা; রামমোহন রায়, জ্যোতিবা ফুলে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ বৌদ্ধিক নেতার উন্মুক্ত দৃষ্টি ও কর্মকাণ্ড, রেলযাত্রা, সরকারি এবং নানা জীবিকা ও বৃত্তি, স্বাধীনতা আন্দোলন, অম্বেডকরের মহৎ প্রয়াস, কমিউনিস্ট আর নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলন এ ব্যবস্থাকে কিছুটা শিথিল করেছিল, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারেনি। তার প্রমাণ ভারতের পরবর্তী ইতিহাস, যা দাঙ্গার ইতিহাসের সঙ্গে দলিতদের ওপর অত্যাচার আর দলিত-হত্যার নানা বীভৎস ঘটনাকে একেবারে আমাদের সময় পর্যন্ত এনে আছড়ে ফেলে। আর দাঙ্গার ধারাবাহিক ইতিহাস তো আছেই। শুধু সংঘটিত দাঙ্গা নয়, রেফ্রিজারেটরে বা সঙ্গে গোমাংস আছে বলে হত্যা, মালদার নিরীহ মুসলমান শ্রমিককে হত্যা এবং হত্যাকারীর বীরত্বের সম্মান, ধর্ষণের ভয়ংকর ঘটনায় কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িকতার রং লাগা-এসবের বিরাম নেই। রবীন্দ্রনাথ যে ‘মনের মানুষ’র কথা বারবার বলেছেন, তা এই জাত, পাত, বর্ণ, শ্রেণির বাইরে এক অ-চিহ্নিত মানুষ-‘যার কোনো সীমা নাই বাহিরের দেশ কালে। সে অন্তরময়, অন্তরে মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।’ ‘মানবসত্তমে’র, বা the essential man-এর এ আদর্শ কোনো ভাববাদী কল্পনা নয়, সুস্থ ও প্রগতিমুখীন গণতন্ত্র সেই মানুষকে মূর্তি দিতে পারে। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র সাধারণ শিক্ষা বিস্তারেই বড় বেশি সময় নিয়েছে, আর শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য উদার মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করা, তাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার পরমুহূর্তে এক বিপুল পরিমাণ নিরক্ষর (৮৩ শতাংশ) জনতার কাছে আমরা এ শিক্ষা পৌঁছে দিতে পারিনি যে ‘দেশ’ কী, ‘ভারতের জাতীয়তা’ বলতে কী বোঝায়, ‘গণতন্ত্র’ কথাটা তাদের জীবনে কীভাবে সত্য হয়ে উঠবে, গণতন্ত্র তাদের কী অধিকার দিতে বাধ্য, কী অধিকার তারা দাবি করতে পারে।
আরেকটা উচ্চ-নিচ অসমতার কথা প্রথম রবীন্দ্রনাথেরই মুখে শুনি আমরা। সেই শ্রেণিভেদ হলো সমাজের উঁচু অংশের সঙ্গে তলাকার-যা আধুনিক সময়ের সৃষ্টি। ইংরেজি পড়া, সরকারি চাকরি করা এবং না করা নতুন পেশাজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বনাম বাকিরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল তৈরি হওয়ার কিছু পরেই রবীন্দ্রনাথ জমিদারির তত্ত্বাবধানে গিয়েছিলেন মধ্যবঙ্গে। প্রায় বারো বছর (১৮৯১-১৯০১) তিনি একটানা কাটিয়েছিলেন সেখানে, পরেও বারবার সেখানে গেছেন। তখনই তার মনে যে প্রশ্নগুলো উঠেছিল সেগুলো হলো, ‘দেশ’ কথাটার অর্থ কী? দেশ কি একটা কল্পনা, না দেশ বাস্তব? এ কল্পনা বনাম বাস্তবে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ খুবই স্পষ্ট-‘ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ সুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র-কিন্তু, ভারতমাতা যে আমাদের সংশ্লিষ্ট পল্লিতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্যভান্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা। যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিণী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরানিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো অমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না।’ (ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ, ‘আত্মশক্তি’)।
চেনা অনুচ্ছেদ, অতি পরিচিত বারবার ব্যবহৃত উদ্ধৃতি। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যে, এখানে রবীন্দ্রনাথের চোখ পড়েছে ভারতীয় নারীর ওপর, যে সমাজের উঁচু-নিচু বিন্যাসে, যে শ্রেণিতেই হোক, তুলনায় নিচেই থাকে, নিরাশ্রয় বিধবাদের তো আরও অসহায় অবস্থা।
কিন্তু শুধু অসহায় নারী নয়, ঔপনিবেশিক শিক্ষা আসায় সমাজে যে নাগরিক ও গ্রামীণ, ধ্বনি, ইংরেজি ব্যবহার করা মধ্যবিত্ত ও তার তলবর্তী মানুষদের নতুন উঁচু-নিচু বিন্যাস তরি হয়েছিল, এবং তৎকালীন রাজনীতি যে মূলত জমিদার ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থের কথা ভেবেছিল, তা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। দেশের বৃহৎসংখ্যক মানুষ যে আমাদের ‘দেশহিতৈষিতার’ বহির্ভূত ছিল, তা ওই ‘সম্ভাষণে’ই তিনি লক্ষ করেছেন, ‘দেশের লোকের হিতের সঙ্গে এই হিতৈষার যোগ নাই। দেশের লোক রোগে মরিতেছে, দারিদ্র্যে জীর্ণ হইতেছে, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় নষ্ট হইতেছে, ইহার প্রতিকারের জন্য যাহারা কিছুমাত্র নিজেদের চেষ্টা প্রয়োগ করিতে প্রবৃত্ত হয় না, তাহারা বিদেশি সাহিত্য-ইতিহাসের পুঁথিগত পেট্রিয়টিজম নানা প্রকার অসংগত অনুকরণের দ্বারা লাভ করিয়াছি বলিয়ে কল্পনা করে।’
রবীন্দ্রনাথের দেশহিতৈষিতা যে তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে, ‘শিক্ষিত’ বাঙালির জন্য ডেপুটিগিরির আরও সুযোগ সৃষ্টির আবেদন-নিবেদন থেকে, সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে, তার দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের মধ্যে আজকের ভাষায় ‘ক্ষমতায়নের’ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবৃতি এখানে অপ্রয়োজন। সুমিত সরকার তাকে reconstructive nationalism আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য শুধু পুনর্গঠন ছিল না, তার সঙ্গে ছিল গ্রামের গরিব প্রজাদের ‘ক্ষমতায়ন’। শ্রীনিকেতনের সংকল্প ও প্রতিষ্ঠার মধ্যেও সেই একই লক্ষ্য ছিল। সেটা অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘A Nation in the Making’। কিন্তু এ নামটাই আমাদের সামনে নানা রকম প্রশ্ন তুলে ধরে। এই nation-making কি একাভিমুখী, যা তৈরি হতে হতে একদিন শেষ হয়ে যাবে? নাকি ইতিহাসে তার নানা উত্থান-পতন চলে, কখনো এ নির্মাণ প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও হয়, যেমন আজকের ভারতে হয়ে চলেছে। জাতির এ সৃজন যে কত সমস্যাসংকুল, তা রবীন্দ্রনাথ যেমন করে বুঝেছিলেন, সেভাবে খুব কম লোকই এদেশে বুঝেছেন বলে আমাদের মনে হয়।
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা