Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা কি দূর হবে না?

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা কি দূর হবে না?

স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় লেখা বা খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব লেখা বা খবর শুধু কালির আঁচড়ে পত্রিকার পাতার মধ্যেই সম্ভবত সীমাবদ্ধ থাকছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন আর সেবাধর্মী কাজ না হয়ে এটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। অথচ আমাদের সংবিধানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর ৩.৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে এবং ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে ২৪.৪ শতাংশ পরিবার। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসে’র তথ্যানুসারে বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে রোগীদের নিজ পকেট থেকে ব্যয় হয় মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ। এ হিসাব ২০১৫ সালের। বর্তমানে এ ব্যয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে নিঃসন্দেহে। স্বাস্থ্য খাতে চরম অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল সংকট ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে গত বছর আগস্টে সংসদে এমপিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তারা বলেন, হাসপাতালগুলোতে মানসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। নেই নার্স, চিকিৎসক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, টেকনিশিয়ান। এসব কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এতে দেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আটটি বছর পেরিয়ে গেলেও এ সমস্যাগুলোর তেমন কোনো সমাধান হচ্ছে না।

বিগত দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে বেড়েছে চিকিৎসা খাতের বৈষম্য। এসব কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনামূল্যে ও সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা, ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যবিমা করা হয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ৪ এপ্রিল এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান যুগান্তরে ‘চিকিৎসায় যান্ত্রিকতা, কমেছে আন্তরিকতা’ শিরোনামে স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব অবস্থা-চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে প্রতিদিন আমরা যে পরিমাণ আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হচ্ছি, তা তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আমি গত ৫ নভেম্বর একই পত্রিকায় ‘স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা আর কতকাল’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থা, অধিকাংশ ডাক্তারের মানবিক আচরণের স্থলে উদাসীনতা, ইচ্ছামতো অস্বাভাবিক ফি আদায়, রোগীকে প্রয়োজন না হলেও আইসিইউতে নেওয়া, টার্গেট পূরণের চেষ্টা করা; রোগীকে নিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা, অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্য লাইফ সাপোর্টে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করা, প্রয়োজন না হলেও কমিশন লাভের আশায় রোগীকে টেস্টের পর টেস্টের পরামর্শ দেওয়া, কোম্পানিগুলোর চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা এবং তাদের খুশি রাখার জন্য প্রেসক্রিপশনে কোম্পানির হয়ে ওষুধ লেখা-এসব অমানবিক ঘটনা ঘটছে অহরহ। কোনো কোনো ডাক্তার নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলার জন্য রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। ছয় মাস আগে সিরিয়াল নেওয়া-এর থেকে আমরা আমজনতা কোনোভাবেই নিস্তার পাচ্ছি না। সুস্থ থাকার জন্য ঘটিবাটি বিক্রয় করে হলেও ডাক্তারের দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। লক্ষ করা যায়, অনেক ডাক্তার নিজ পেশায় একেবারেই উদাসীন। যত রূঢ় আচরণই করুন না কেন, তাদের কাছে বাধ্য হয়ে যেতে হয় আমাদের। তারাও জানেন, তাদের কাছে আমাদের যেতেই হবে। ডাক্তারদের অবহেলার কারণে প্রতিদিন কত মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে, কত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে তার কটা খবর আমরা জানি বা পত্রিকার পাতায় আসে? আমরা আমজনতা অসহায়। কার কাছে, কোথায় যাব আমাদের অভিযোগ-অনুযোগ জানাতে? তবে এদের মধ্যে অনেক ভালো অর্থাৎ মানবিকগুণসম্পন্ন ডাক্তারও রয়েছেন; কিন্তু এ সংখ্যা অনেক কম। এক কথায়, সেবার ব্রত নিয়ে এ পেশায় প্রবেশ করলেও অনেক ডাক্তারই তা মনে রাখেন না। তাদের অনেকেই যেন টাকা রোজগারের মেশিন। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। গত দুই যুগের ব্যবধানে দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠার কারণ মূলত সরকারি হাসপাতালে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সুষ্ঠু তদারকির অভাব ও সর্বোপরি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিকাশের ফলে মানুষের সেবাপ্রাপ্তি সহজ হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেবার মান নিয়ে রয়েছে বহু অভিযোগ। কোনো নীতিমালা ছাড়াই চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার কোনো কোনো সময় ভুল রিপোর্ট দিয়ে মানুষকে হয়রানি করে। এতে মানুষকে আর্থিক ও মানসিকভাবেও হয়রানি করা হচ্ছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টের সংকট রয়েছে। এছাড়া নেই প্রয়োজনীয় আধুনিক মানের যন্ত্রপাতিও। কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই দক্ষ অপারেটর। ফলে ব্যয়বহুল এসব যন্ত্রপাতি অকেজো অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার ছাড়াও একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী লোপাট করে নিজেদের পকেট ভারী করছে। এসব দেখার কেউ থাকলে দীর্ঘদিন ধরে একই অবস্থা বিরাজ করত না।

গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর পত্রিকান্তরে প্রকাশ-দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং টারশিয়ারি ও বিশেষায়িতসহ ৫১৭টি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের ওষুধ বিতরণে অন্তত ২ হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সৃষ্ট ৫২টি পদের বিপরীতে মাত্র ছয়জন কাজ করছেন। একইভাবে দেশের অন্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১২ হাজার ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ৩২৮৬ জন। ফলে ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মূল্য, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এত উচ্চমূল্য দিয়ে যে ওষুধ ক্রয় করা হচ্ছে, তা-ও ভেজালে ভরা। সুস্থ, স্বাভাবিক থাকা এবং জীবন রক্ষার্থে চিকিৎসা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে একটা শ্রেণি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রবীণ জনগোষ্ঠী।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতও এর ব্যতিক্রম নয়; এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে। ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। এ খাতে আমাদের অর্জন কিন্তু কম নয়। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে একশ্রেণির বিবেকবর্জিত ডাক্তার, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

২ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, নতুন বৈশ্বিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি ডাক্তারদের উদ্দেশে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ডাক্তারদের একটি মহল এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর চিকিৎসা চর্চা ও গবেষণা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরি অথবা রাজনীতিতে চলে যান। আর একশ্রেণি আছেন, যারা শুধু টাকা রোজগারেই ব্যস্ত এবং একইসঙ্গে সরকারি চাকরি ও প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করেন। স্বাস্থ্য খাতের ওপর গবেষণা কম হওয়ায় তিনি এ খাতের গবেষণার ওপর জোর দেন।

দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি জনগণের মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে অব্যবস্থাপনা শক্ত হাতে দূর করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আধুনিক মানসম্মত যন্ত্রপাতি স্থাপন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডাক্তার-নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য আসছে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যনীতি সংস্কার করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ডাক্তারদের ফি নির্ধারণ করে সরকারি-বেসরকারি উভয় হাসপাতালগুলোর জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা দরকার। মানুষ সুস্থ থাকলে সরকারের অর্জনগুলো তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হবে।

মনজু আরা বেগম : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম