আশেপাশে চারপাশে
গ্যাস দুর্ঘটনার ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়েই কি আমাদের চলতে হবে?
চপল বাশার
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা মহানগরীর দুই কোটির বেশি মানুষ একটি বিরাট ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। নগরীর মাটির তলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে সাত হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাসের পাইপলাইন। মেয়াদোত্তীর্ণ ও জরাজীর্ণ এ পাইপলাইন যে কোনো সময়ে বিস্ফোরিত হলে সারা শহরে আগুন ধরে যেতে পারে। গ্যাস পাইপলাইনে আগুন যদি একবার লাগে, তাহলে শহরের ভিআইপি-ধনী-দরিদ্র কেউ রেহাই পাবেন না। হয় পুড়ে মরবেন, না হয় গুরুতর দগ্ধ হবেন।
গত ২৪ এপ্রিল রাতে ঢাকার এক বিরাট এলাকাজুড়ে যা ঘটে গেল, সে প্রসঙ্গেই আমার এ আশঙ্কার কথা বলছি। সেদিন ছিল সোমবার। রাত ১১টার মতো। শহরের উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকের বিস্তীর্ণ জনপদে হঠাৎ তীব্র গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। মগবাজার, ইস্কাটন, রামপুরা, দিলু রোড, মহাখালী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, পূর্ব রাজাবাজার, বাড্ডা ও হাজারীবাগ এলাকায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। এলাকার আতঙ্কিত মানুষ ৯৯৯ নম্বরে অথবা ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং দেখে ঘটনা সত্য।
তারা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানায় এবং ব্যবস্থা নিতে বলে। বেশ কিছুক্ষণ এ অবস্থা চলার পর তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলে, ‘গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা চাপ কমিয়ে দিয়েছি। ধীরে ধীরে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ রাত ১২টার পর এক ফেসবুক পোস্টে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানায়, ‘ঈদে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বা ওভার ফ্লো হওয়ায় গ্যাসের গন্ধ বাইরে আসছে।’
ত্রুটিযুক্ত-জরাজীর্ণ পাইপলাইন : মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন থেকে যায়, শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকলে সেখানে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এটাই তো নিয়ম। বন্ধ কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হলে চাপ তো বাড়বেই। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন থেকে আগেই সরবরাহ বন্ধ করা বা কমিয়ে দেওয়াই কি উচিত ছিল না? আরও একটি প্রশ্ন। পাইপে গ্যাসের চাপ বাড়তেই পারে। কিন্তু সেটা বেরিয়ে গেল কীভাবে? পাইপে নিশ্চয়ই ছিদ্র বা ফুটোফাটা ছিল।
গ্যাসের লাইনের ত্রুটি যে কত ব্যাপক তা ২৪ এপ্রিল রাতের ঘটনাতেই বোঝা গেছে। মগবাজার থেকে শুরু করে বসুন্ধরা ও হাজারীবাগ পর্যন্ত বিশাল এলাকার সর্বত্রই গ্যাস পাইপলাইন ত্রুটিযুক্ত অথবা জরাজীর্ণ। মন্ত্রণালয় ও তিতাস কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্যে সুকৌশলে পাইপলাইনে ছিদ্র-ফুটো বা ত্রুটির কথা এড়িয়ে গেছে।
কারিগরি বা যান্ত্রিক যে কোনো ক্ষেত্রে মেইনটেন্যান্স বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের একটি বিষয় থাকে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তাদের পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ কতটা করে বা আদৌ করে কিনা সে বিষয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। ৫০-৬০ বছর বা দীর্ঘকাল আগে বসানো পাইপলাইনের অবস্থা তারা জানে কি? সাত হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের কতটা এখনো ব্যবহারযোগ্য আছে সে খবরও তারা বোধহয় রাখে না। এহেন পুরোনো-জরাজীর্ণ পাইপলাইন দিয়ে নগরবাসীকে গ্যাস সরবরাহ করে তারা আমাদের বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। ২৪ তারিখের ঘটনাটা অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। সেটা আরও ভয়াবহ হতে পারত।
অশনিসংকেত : ঘটনাটিকে আমি বলব একটি অশনিসংকেত। সরকার, মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং জনগণ-সবার জন্য আগাম সতর্কবার্তা। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে গ্যাসসংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা আর না ঘটে, নগরবাসী যেন নিরাপদে থাকে। সরকারের উচিত হবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা। কমিটির দায়িত্ব হবে গ্যাস সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা ও ত্রুটিমুক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার লক্ষ্যে সুপারিশ করা।
ঢাকায় যে গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে, তা বসানো হয় পাকিস্তানি শাসনামলে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কী উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছিল, ভালো না মন্দ, সেটা তখন বোঝা যায়নি। তবে এটা ঠিক ঢাকার বাসিন্দারা খুশি হয়েছিলেন, তাদের জ্বালানি সমস্যা মিটবে এ আশায়। পাইপ বসানো শুরু হলো, অলিতেগলিতে লাইন গেল, উচ্চাবিত্ত-মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে গ্যাস পৌঁছে গেল। সীমিত আকারে শুরু হলেও ক্রমেই পাইপলাইনের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হতে লাগল, পৌঁছে গেল নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত।
গ্যাস সরবরাহের জন্য মাসিক হারে ভাড়া প্রদানের পদ্ধতি প্রথম থেকেই চালু হয়। প্রথম দিকে ভাড়ার হার ছিল অনেক কম। মধ্যবিত্ত-নিুবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পরে প্রতি বছরই এটা বাড়তে থাকল। বর্তমানে দুই বার্নার চুলার জন্য মাসে দিতে হয় ১০৮০ টাকা। এক বার্নারের জন্য কিছু কম। গ্যাস সরবরাহ থাকুক না থাকুক, চুলা জ্বলুক না জ্বলুক, মাসিক ভাড়া দিতেই হবে। অন্যথায় জরিমানা অথবা লাইন কাটা।
রমজানের আগে বেশ কয়েক মাস গ্যাস সরবরাহ অনিয়মিত ছিল। কোনো কোনো দিন গ্যাস মোটেই আসত না, এলেও আসত মধ্যরাতে যখন মানুষের প্রয়োজন থাকত না। সে সময়ে ঢাকার বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে গ্যাস সিলিন্ডার ও নতুন চুলা কিনেছিলেন রান্নাবান্নার জন্য। হাজার হাজার চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডার তখন বিক্রি হয়েছে এ শহরে। মানুষের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সে সময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়েছে। এক হাজার টাকার সিলিন্ডার ১৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে।
পাইপলাইন না সিলিন্ডার : তিতাস গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয় ১৯৬২ সালে। এটিই দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। তিতাসের পর একটির পর একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হতে থাকে। সে সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় শিল্প-কারখানা ছাড়াও বাসাবাড়িতে রান্নার কাজের জন্য পাইপলাইনে গ্যাস দেওয়ার।
বিজ্ঞজনরা সে সময়েই বলেছিলেন, পাইপলাইনে না দিয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ হোক। পাইপলাইনের চেয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস দিলে সরকারের খরচ কম হবে, গ্যাসের অপচয় হবে না। ভোক্তারাও হিসাব করে গ্যাস খরচ করবেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তৎকালীন সরকার পাইপলাইনের ব্যবস্থাই বহাল রাখে এবং এখনো তা আছে। তবে গ্যাস সংকট দেখা দেওয়ায় বর্তমান সরকার ২০১০ সাল থেকে পাইপলাইনে নতুন আবাসিক সংযোগ দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে পাইপলাইনে আবাসিক ভবনের রান্নাঘরে গ্যাস পৌঁছে দেওয়া হয়। অন্যান্য দেশে দেখেছি এবং শুনেছি, রান্নার জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হয় সিলিন্ডারে। পাইপলাইনে রান্নার গ্যাস পাওয়ার কথা তারা চিন্তাও করে না।
একটি কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, পাইপলাইনে আবাসিক ভবনে সরবরাহের কারণে গ্যাসের অপচয় হয়। অনেকেই দিয়াশলাইর কাঠি খরচ করবেন না বলে চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। অনেকে আবার চুলা জ্বালিয়ে রেখে তার ওপর কাপড় শুকাতে দেন। তাদের যুক্তি-গ্যাস খরচ করি আর না করি, মাসিক ভাড়া তো দিতেই হবে নির্ধারিত হারে। সিলিন্ডার পদ্ধতি চালু থাকলে কেউ এভাবে অপচয় করবেন না। নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস ভোক্তাকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়েই কিনতে হয়।
ন্যায্যমূল্যে সিলিন্ডার গ্যাস : সিলিন্ডার পদ্ধতির গ্যাস ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা যখন-তখন তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে না পারে। ভোক্তারা যাতে ন্যায্যমূল্যে সহজেই সিলিন্ডার গ্যাস পেতে পারেন সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। সরকার আবাসিক খাতে পাইপলাইনে পর্যাপ্ত গ্যাস যখন দিতে পারছে না, তখন সিলিন্ডার ব্যবস্থাকেই উৎসাহিত করা উচিত নয় কি? সিলিন্ডারে যে দুর্ঘটনা ঘটে না তা নয়। তবে এসব দুর্ঘটনা হয় অসচেতনতা এবং সিলিন্ডার ব্যবহারে অনভ্যাসের কারণে। সব ক্ষেত্রেই আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
নতুন পাইপলাইন বসাতে হবে : লেখাটি শুরু করেছিলাম ২৪ এপ্রিল রাতে ঢাকা মহানগরীর উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাইপলাইনে গ্যাস লিকেজের ঘটনা নিয়ে। একটি বড় দুর্ঘটনা থেকে সেদিন ঢাকাবাসী বেঁচে গেছেন। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জনগণকে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করেছেন। আতঙ্কিত না হয়ে উপায় আছে কি?
ইতোমধ্যে গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিতাস গ্যাসের মেয়াদোত্তীর্ণ-জরাজীর্ণ পাইপলাইনে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এসব ছিদ্র দিয়ে প্রতিদিনই গ্যাস বের হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে না, এটি ভাগ্যের কথা। পাইপলাইন যখন থাকছেই, তাহলে এগুলোর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক, নিয়মিত তদারক করা হোক। প্রয়োজন হলে পুরোনো পাইপ বদলে নতুন পাইপলাইন বসাতে হবে। এক্ষেত্রে নমনীয়তা বা ঢিলেমির সুযোগ নেই। এটি মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও বোধোদয়।
চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com