Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্পষ্ট হয়ে উঠছে শিল্প খাতের সংকট

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্পষ্ট হয়ে উঠছে শিল্প খাতের সংকট

অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি দেশের সমৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সন্দেহ নেই। তবে সমৃদ্ধির তা একমাত্র উপকরণ নয়।

শিল্পায়ন আর্থিক সংগতির একটি বড় শর্ত। শিল্পকারখানার উৎপাদন মানুষের ভোগচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তৈরি করে কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে মানুষের আয়ের পরিমাণ বাড়ে এবং তা নতুন চাহিদার সৃষ্টি করে। এ নতুন চাহিদা আবার নতুন জোগানের তাগিদ দেয়। এ থেকে অধিকতর উৎপাদনের প্রয়োজন পড়ে, যা করতে গেলে কর্মনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিতে এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এ গতিশীলতার ব্যত্যয় ঘটলে অর্থনীতি উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে; জীবনমান নিুমুখী হতে থাকে। আমাদের অর্থনীতিতে এখন সেরকম ধারাই চলছে, যা উদ্বেগজনক।

দেশে শিল্প খাতের উৎপাদন কমে গেছে। সাধারণত শিল্পোৎপাদন বছর বছর বৃদ্ধি পাওয়াটাই হলো প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের তা কমতির দিকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে এ উদ্বেগের খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ৯ শতাংশ কমে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্প খাতে উৎপাদন বেড়েছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। তবে এপ্রিল-জুনে তা কমে ৩ শতাংশে নেমে এসেছিল, পরে বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ২২ উপখাতের ১৩টিতে উৎপাদন কমেছে। কোনো কোনোটিতে উৎপাদন নেতিবাচক মাত্রায় পৌঁছেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের উৎপাদনের কিছু চিত্র ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে তুলে ধরা যেতে পারে। গত অর্থবছরে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ১১ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে মাইনাস ৪ শতাংশ। বস্ত্র খাতের অবস্থা আরও করুণ। গেল বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬ শতাংশ; এবারে সেই প্রবৃদ্ধির হার কমে হয়েছে মাইনাস ১ শতাংশ। আমাদের দেশে বছর বছর রোগ ও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ওষুধের চাহিদা। কিন্তু সেই ওষুধের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওষুধ শিল্পে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২ শতাংশ, এবারে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে। চামড়াশিল্পের অবস্থা আরও নাজুক। গেল অর্থবছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এসে এ খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাইনাস ১২ শতাংশে। পেট্রোলিয়াম পণ্যের উৎপাদনও নেতিবাচক। এক বছরে প্রবৃদ্ধির হার মাইনাস ২ শতাংশ।

এ কমে যাওয়ার দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে। এসব পণ্য দেশীয়ভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মেটায়, পাশাপাশি রপ্তানিও করা হয়। উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে, অন্যদিকে রপ্তানি কমে গেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, শিল্পোৎপাদনের মৌলিক উপাদানগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ হলো-ডলার, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ। উল্লিখিত উপকরণগুলোয় সংকট থাকায় দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। যুগান্তরের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে একদিকে যেমন বৈশ্বিক পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে হুহু করে বেড়ে যায় পণ্যের দাম। এতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এ বাড়তি আমদনি ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাড়তি ডলারের জোগান দিতে হয়। আবার বাড়তি ডলারের জোগান দিতে গিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ভীষণ চাপ পড়ে। এ চাপ সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। উদ্যোগের অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের এপ্রিলে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করে। মে মাসে তা বাড়িয়ে মার্জিনের পরিমাণ শতভাগ করা হয়। তারপরও সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকগুলো আর ডলারের সংস্থান করতে পারছিল না, তাই এলসি খোলা সীমিত করে দেয়। উত্তরোত্তর ডলারের চাহিদা বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে থাকে লাগামহীনভাবে। এ বৃদ্ধির হার ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। আমরা তো শুধু বিলাস দ্রব্যই আমদানি করি না, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হয়। এ ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্যের আমদানিও বাধাগ্রস্ত হয়। এর কুফল ভোগ করে শিল্প খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। অনেক শিল্প উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কিছু কিছু খাতের অবস্থা ভয়াবহ। মেটাল, রড, ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। সেখানে উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাই দায়।

কৃষি উৎপাদনের সংবাদও ভালো নয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ১৭ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছিল। এবারেরর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ টন। অর্থাৎ, এ বছর প্রায় ৪ লাখ টন কম সবজি উৎপাদন হবে বলে কৃষিসংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

শিল্প খাতে উৎপাদন কমার পাশাপাশি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের চাহিদা সংকুচিত হওয়ায় এবং উৎপাদন-উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের জনিুয়ারি থেকে মার্চ-এ তিন মাসে ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের অওতাধীন কারখানা রয়েছে ২৯টি, আর সংগঠনের বাইরে রয়েছে ৬৮টি। দেশের শিল্পাঞ্চলকে ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়-ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা। সবচেয়ে বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে গাজীপুরে। সেখানে সংগঠনভুক্ত ১০টি এবং সংগঠনের বাইরে ১৯টি কারখানা গত তিন মাসে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। এ খাতের সর্ববৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) আওতাধীন ১৭টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ); এ খাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বন্ধ হয়ে গেছে তিনটি কারখানা এবং বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

চলমান কারখানা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু কিছু কারখানাও নতুনভাবে চালু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বেশির ভাগই ঠিকা কাজের বা সাব-কন্ট্রাক্ট। কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানকে কিছু কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। এটাকে কোনো স্থায়ী বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না। শিল্প মালিকরা বলছেন, বড় বাজারভিত্তিক দেশগুলোর বর্তমান অগ্রাধিকারের বিষয় জ্বালানি, খাদ্য ও আবাসন ব্যয়। দেশগুলোর চাকরির বাজারও সুবিধার নয়। এ কারণে আমাদের দেশের রপ্তানিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যে বাজার থেকে তিন লাখ পিস অর্ডার পাওয়া যেত, তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক লাখে। তাই বড় কারখানাগুলো কোনো রকমে টিকে থাকতে পারলেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট কারখানাগুলো।

শুরুতেই বলেছি, উৎপাদনের প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভূমিকায় থাকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেল। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ডলারের দাম। আমরা কোনোটাকেই সহনীয় মাত্রায় রাখতে পারিনি। আমরা কোনো উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক পরিস্থিতির অজুহাত দেই, কিন্তু দাম কমলে তার প্রভাব লক্ষ করি না। একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। বিশ্ববাজারের অজুহাতে গত সপ্তাহে সারের দাম নতুন করে বাড়ানো হয়েছে। অথচ ১২ এপ্রিলের সংবাদমাধ্যম বলছে, বিশ্ববাজারে সারের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আমাদের দেশে সাধারণত প্রধান সার হিসাবে ব্যবহৃত হয় ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম ছিল, ২০২৩ সালের একই সময়ে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ইউরিয়া কমেছে ৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ, টিএসপি কমেছে ২৪ দশমিক ৮৮, ডিএপি কমেছে ২৩ দশমিক ৭৬ এবং এমওপি কমেছে ৪৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। অথচ একই সময়ে আমাদের দেশে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের বেলাতেও সমন্বয়ের কোনো লক্ষণ দেখি না।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত। চলছে ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্বলতাগুলো বিবেচনায় না নিলে কারও ক্ষমতাই স্বস্তির হবে না। উৎপাদনের অধোগতি কারও জন্যই সুখকর হবে না।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম