Logo
Logo
×

বাতায়ন

এমপিওভুক্তিতে মাউশির দুর্নীতিমুক্ত সেবা চাই

Icon

শরীফুজ্জামান আগা খান

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এমপিওভুক্তিতে মাউশির দুর্নীতিমুক্ত সেবা চাই

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় ‘মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয় : ঘুস ছাড়া মেলে না এমপিও’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির আবেদন নিষ্পত্তি করতে সেবাপ্রার্থীদের নির্ধারিত হারে অর্থ দিতে হয় অথবা প্রভাবশালী মহল থেকে তদবির করাতে হয়।

এ দুটির কোনোটির আশ্রয় না নিলে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। কখনো আবার নানা ত্রুটি ধরে আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুস ছাড়া এমপিও মেলে না বললেই চলে। প্রতিবেদনে কাজের ধরনভেদে ঘুসের রেটের উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষকের নতুন এমপিওভুক্তিতে লাগে ১০ হাজার টাকা। আর কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলে ২০ হাজার টাকা। কর্মচারী এমপিওভুক্তিতে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। উচ্চতর স্কেল পেতে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। বকেয়া এমপিও দাবি পাশ করাতে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

প্রতিবেদক অভিযোগ যাচাই করতে ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালকের দপ্তরে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে স্কুলের দুই কর্মচারীর এমপিওভুক্তির বিষয়ে উচ্চমান সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি কাগজপত্র ঠিক থাকলে ২০ হাজার টাকা আর কাগজপত্র ঠিক না থাকলে রেট ৫০ হাজার টাকার কথা বলেন। পরে ১৫ হাজার টাকায় ঘুসের রফা হয়।

২০২১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার আলোকে ২০২২ সালে ২ হাজার ৭৩০টি নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আরও শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওই তালিকায় যুক্ত হয়। এখন ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চলছে।

গত বছর ৩০ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান, একাডেমিক স্বীকৃতি, এমপিও কোড ও অন্যান্য কাগজপত্র এবং ব্যক্তি এমপিওর ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের সব পরীক্ষার সনদ/মার্কসিট ও নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্রের মূল কপিসহ প্রতিষ্ঠান সরেজমিন যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠনের এক পরিপত্র জারি করে। তিনজন সদস্য করে তিন পর্যায়ের কমিটি। উপজেলা/থানা পর্যায়ের কমিটির সদস্যরা হলেন-সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানার শিক্ষা অফিসার, সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং ওই উপজেলা/থানার পুরোনো কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। এ কমিটি সরেজমিন মূল কাগজপত্র যাচাই করবে। যাচাই শেষে সঠিকতা থাকলে প্রতিষ্ঠানপ্রধান পরবর্তী ধাপে আবেদন করবেন।

জেলা পর্যায়ের কমিটি সংশ্লিষ্ট জেলার শিক্ষা অফিসার, সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং জেলা সদরের এমপিওভুক্ত উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত। অনুরূপভাবে অঞ্চল পর্যায়ের কমিটিতে উপপরিচালক ও অপর দুজন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ের নির্ধারিত কাজ হলো প্রাপ্ত আবেদনগুলোর সংশ্লিষ্ট স্তর যাচাই করা।

২০২১ সালের এমপিও নীতিমালার আলোকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পাবলিক পরীক্ষার পরীক্ষার্থী এবং পাশের হারের ওপর ভিত্তি করে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ইতঃপূর্বে ২০১৮ সালের এমপিওর ক্ষেত্রেও এরকম সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। ফলে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটার সংগ্রহের বিড়ম্বনা ও পক্ষপাত এবং বড় ধরনের উৎকোচ প্রদান থেকে রেহাই মিলেছে।

ম্যানেজিং কমিটির হাতে শিক্ষক নিয়োগের সময় স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনা ঘটত। এরকম অনিয়ম রোধে এনটিআরসিএ থেকে সরাসরি নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করায় এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অধিকতর মানসম্মত শিক্ষক পাচ্ছে। নীতিনির্ধারণী মহলের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও শিক্ষা অফিসের নানা পর্যায়ে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য শিক্ষকদের ভোগান্তির শেষ নেই।

উপজেলা/থানা কমিটির পর জেলা কমিটি দ্বারা কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর নতুন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আবেদন মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ে যাচ্ছে। আমার উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার একজন সজ্জন ব্যক্তি। তিনি সততার সঙ্গে কমিটির অপর দুই সদস্যকে নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দেশের নানা প্রান্তে নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো কোনো এলাকায় একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দ্বারা বড়সংখ্যক প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। অগত্যা তাদের বড় অঙ্কের উৎকোচ প্রদান করে কোনো একটি ধাপের কাজ সমাধা করাতে হচ্ছে।

এমপিওভুক্তির কাজের শেষ ধাপ হলো মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়। আমার অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা মাউশিতে কাগজপত্র জমা দিতে গেলে উচ্চমান সহকারী ও প্রোগ্রামাররা মাথাপিছু বড় অঙ্কের ঘুস দাবি করছেন বলে জানালেন। প্রতিষ্ঠান আবার মাউশি থেকে ভিজিট করা হবে, মূল কাগজপত্র আবার যাচাই করা হবে, আবেদনের নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে-এ রকম কথা বলে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের টেনশন বাড়িয়ে বড় অঙ্কের উৎকোচ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কমিটি কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার পর আঞ্চলিক কমিটি আবারও পুরো অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে গেলে তা হবে সময়সাপেক্ষ কাজ। একটি নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কমিটির প্রত্যেক সদস্য ৩ সেট কাগজে অন্তত ১৫টি স্বাক্ষর করেছেন। একটি অঞ্চল কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে গঠিত। গড়ে একটি অঞ্চলে ৩০০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পড়েছে। আঞ্চলিক কমিটি উপজেলা ও জেলা কমিটির অনুরূপ পেপার তৈরি করে স্বাক্ষর করতে গেলে কমিটির একজন সদস্যকে সাড়ে চার হাজারের মতো স্বাক্ষর করতে হবে।

কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইনে এমপিওভুক্তির কাগজপত্র দাখিল করার অনুমতি মিলবে। এখন মাউশির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইনে আবেদনের পাসওয়ার্ড প্রদানের দায়িত্ব পেলে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের জিম্মি করে বড় অঙ্কের ঘুস দাবি করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। গতবার মন্ত্রণালয় থেকে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির একটি অভিন্ন পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাসওয়ার্ড কোড বদলে নেয়। আমরা চাচ্ছি মন্ত্রণালয় থেকে যেন আগের মতো অভিন্ন পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়।

শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের ভেতর নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো। নৈতিক শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষকের নৈতিক মান ধারণ করতে হয়। এখন বেতন করাতে গিয়ে কিংবা অফিসিয়াল কোনো কাজ করতে গিয়ে পদে পদে উৎকোচ দিতে বাধ্য হলে শিক্ষকের নৈতিক মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের নীতিশিক্ষা দেওয়ার মতো নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমাবেশে উচ্চারিত শপথবাক্য নেহায়েত কথার কথা হয়ে দাঁড়ায়।

সংবাদপত্রে সুনির্দিষ্টভাবে ঘুসের অভিযোগ আসার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাউশির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা জানা নেই। সেটা না হলে তা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনুসৃত সুনীতি মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অপতৎপরতায় ভেস্তে যাওয়া কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাউশির দুর্নীতি প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ঘুস ছাড়াই এমপিও মিলবে।

শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম