স্বদেশ ভাবনা
মূল্যস্ফীতি পুষ্টিহীনতাকে আরও প্রকট করবে
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এমনিতেই বাংলাদেশের জনসাধারণের পুষ্টি পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের অনেক নিচে; চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে (মার্চে ৯.৩৩ শতাংশ) মানুষের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহে আর্থিক অসামর্থ্যতা এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটাবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক সাম্প্রতিক জরিপে উঠে আসা ফাইন্ডিংস এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
২৯ মার্চ রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এক সংবাদ সম্মেলনে সানেমের জরিপে উঠে আসা ফাইন্ডিংস পত্রপত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে আয় না বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতার অভাবে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করতে না পারা ছাড়া আর যেসব ফ্যাক্টরকে পুষ্টিহীনতার জন্য দায়ী করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ, বাজারে পুষ্টিমানহীন ও ভেজাল খাবারের নিয়ন্ত্রণহীন সরবরাহ, খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহার এবং পুষ্টি সমস্যা সম্পর্কে অসচেতনতা। সানেমের জরিপের ফাইন্ডিংসসহ এসব ফ্যাক্টর পর্যালোচনা করা এবং কীভাবে পুষ্টি সমস্যার উন্নতি করা যায়, তা আলোচনা করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দেশের আটটি বিভাগের ১ হাজার ৬০০ নিম্নআয়ের পরিবারের ওপর সেপ্টেম্বর ২০২২-ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সময়কালে পরিচালিত সানেমের জরিপে যেসব ফাইন্ডিংস উঠে এসেছে সেগুলো হলো-১৮ শতাংশ পরিবারকে কখনো কখনো পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে; ৭১ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খেয়েছে; ৩৭ শতাংশ পরিবার মাঝেমধ্যে কোনো একবেলা খাবার না খেয়ে থেকেছে; ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল, ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম, ৮৮ শতাংশ পরিবার মাছ এবং ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাবার কমিয়েছে; ৯০ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে; ৪৫ শতাংশ পরিবার ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদের হারে ধার করেছে; ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে, আগামী ৬ মাসে আরও ধার করতে হবে; ৩৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে এবং ৫৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয়বিমুখ হয়েছে।
জরিপের ফাইন্ডিংস উপস্থাপনের পর সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, এ জরিপে দেশের সব নিম্নআয়ের মানুষের চিত্র পুরোপুরি উঠে এসেছে কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়েছে-এমনটা বলা না গেলেও সামগ্রিক অবস্থার একটা ধারণা অন্তত পাওয়া সম্ভব। তিনি আরও বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের পরিবার ছাড়াও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার চাপে আছে। মধ্যবিত্তের অনেকে ভাবছেন, তারা এখন নিম্নআয় গোষ্ঠীর মধ্যে চলে এসেছেন।
আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেড়ে গেলে এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেলে সমাজের স্তর বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটতে পারে। মধ্যবিত্ত স্তরের অনেকে নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্তরে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত স্তরের অনেকে দরিদ্রের স্তরে এবং দরিদ্র স্তরের অনেকে অতিদরিদ্রের স্তরে নেমে যেতে পারে। দেশে দরিদ্র মানুষের শতকরা হার জানা গেলেও নিম্নআয়ের মানুষের শতকরা হার জানা যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভেতে (হায়েস) দেশে দারিদ্র্যহার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যবহৃত এ তথ্য পুরোনো। এ তথ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপকালের আগের। এর সত্যতা মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমেছে বলে হিসাব করা হয়।’ এদিকে দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন-সিপিডি, পিপিআরসি, বিজিডির মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার ফলাফলে প্রাপ্ত দারিদ্র্যহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও করোনাকালীন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে বর্তমানে দারিদ্র্য হার কত। দেশে দারিদ্রহার যাই হোক, নিম্নআয়ের মানুষের হার যে এর চেয়ে বেশি হবে, তা ধরে নেওয়া যেতে পারে।
বাজারে পুষ্টিমানহীন ও ভেজাল খাবারের নিয়ন্ত্রণহীন সরবরাহ পুষ্টি সমস্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। আমাদের প্রধান খাদ্য চালে ভেজাল। বিভিন্ন অটো রাইস মিল চাল কেটে বা ছেঁটে পুষ্টিগুণ নষ্ট করে বাজারজাত বা বিক্রি করায় জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। মুড়িতে ইউরিয়া, মাছ, দুধ, ফলমূলে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক, শুঁটকিতে ডিডিটি, ভাজা খাবারে লুব্রিক্যান্ট, বিস্কুট, আইসক্রিম ও নুডুল্সে টেক্সটাইল ও লেদার রং, গুঁড়া মসলায় ভুসি, ইটের গুঁড়া-এসব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ভেজালের দৌরাত্ম্য রয়েছে মধু, মিষ্টি, দধি, আচার, ঘি, জুস, ডালডা, সেমাই, ভোজ্যতেল ও বেসনে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল মোটাতাজা করতে খাওয়ানো হয় বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল। মাছ অল্প সময়ে বড় করার জন্য ব্যবহার করা হয় হরমোনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল। বাজারে পুষ্টিমানহীন ও ভেজাল খাবারের নিয়ন্ত্রণহীন সরবরাহ একদিকে জনগণের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে অপুষ্টির হার বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পুষ্টি সম্পর্কে অসচেতনতা প্রকাশ পায়। পরিবার পর্যায়ে, বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবারে পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। পুরুষ সদস্যদের খাওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, তা নিয়ে নারীদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এতে তারা অপুষ্টিতে ভোগে। দুই. ত্রুটিপূর্ণ রন্ধন পদ্ধতির জন্য, বিশেষ করে শাকসবজিসহ খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান ত্রুটিপূর্ণভাবে কাটা, অতিরিক্ত ধোঁয়া ও অত্যধিক তাপের কারণে এগুলোর পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) আর্থিক সহায়তায় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি ও প্রকাশিত বাংলাদেশ আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপ বা অপুষ্টি মানচিত্র ২০১৪-এর ফাইন্ডিংসের মধ্যে রয়েছে-ক. গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি সাধন হলেও, দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও, প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রায় সক্ষম হলেও, জন্মহার ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও, শিক্ষার হার বেড়ে গেলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। অষ্টম পষ্ণবার্ষিক পরিকল্পনায় (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) দেশে ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবার বড় বড় অসমতার’ কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি সেবার পরিধি ও গুণগত মান বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জাতীয় খাদ্যনীতিতে বলা হয়েছে, দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে পুষ্টি সমস্যা প্রকটভাবে বিদ্যমান। সমস্যা সমাধানে যেসব কৌশল অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক প্রয়োজন অনুসারে সুষম খাদ্য গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা; খ. দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা; গ. পুষ্টি-শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা; ঘ. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা বহুমুখীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ঙ. নিরাপদ পানি ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করা; চ. নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ করা।
‘দ্য স্টেট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। সানেমের গবেষণা জরিপে উঠে আসা তথ্য মোতাবেক ক্রয়ক্ষমতার অভাবে নিম্নআয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের অভুক্ত ও অর্ধ্বভুক্ত থাকা, আমিষজাতীয় খাবার কমিয়ে দেওয়া দেশের অসন্তোষজনক পুষ্টি পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ সমস্যা সমাধানে যা প্রয়োজন তা হলো নিম্নআয়ের মানুষের আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া। এজন্য যা করতে হবে তা হলো-তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যহ্রাস। সেই সঙ্গে অন্য যেসব ফ্যাক্টর পুষ্টি সমস্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসাবে কাজ করছে, সেগুলো দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশে পুষ্টিহীনতা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে এবং বৈশ্বিক পুষ্টি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে নেমে যাবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com