Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মরণ

এক অনন্য ব্যতিক্রমী বিচারপতি

Icon

আতিক হেলাল

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এক অনন্য ব্যতিক্রমী বিচারপতি

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ছিলেন উপমহাদেশের একজন স্বনামধন্য আইনবিদ। তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব। বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও তিনি নানা ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন। মানবতাবাদী, সমাজহিতৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অবিভক্ত বঙ্গে স্যার সৈয়দ আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসাবে তার এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলের এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি তার কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই একপর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারপতি জীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।

বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষায় তার দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখণ্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ্য সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।

১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের জন্ম। শিক্ষাজীবনে তিনি একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম হতেন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পাশের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। কলেজজীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও সম্পৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার। একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজ জীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ত্রিশের দশকে মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। সেকালে মুসলমান তরুণদের মধ্যে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে একধরনের অনীহা ও অবহেলা ছিল, তরুণ মাহবুব মোরশেদ সেই নেতিবাচক অবস্থা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতিমান অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত ‘লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল’ (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরেবাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন প্রভৃতি ঘটনায় সময়টা ছিল উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রাখেন। ১৯৫৫ সালে যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসাবে যোগ দিন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাদের একজন।

তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে। দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এ সময়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও কিছুদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আইনের শাসনের অবিচল প্রবক্তা ছিলেন।

১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেক রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো জারি করলেন, যার ফলে এদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টেরও (আপলি বিভাগ) এডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচণ্ড সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে সেসময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে করা একটি দেশদ্রোহ মামলায় যুক্তিতর্ক ছাড়াই তাকে জামিন দিয়েছিলেন বিচারপতি মোরশেদ। তখন তৎকালীন রাষ্ট্রপক্ষ তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, শেখ মুজিবকে এভাবে জামিন দেওয়া হলে সরকার রুষ্ট হবে। তখন বিচারপতি মোরশেদ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ওদেরকে বলে দেবেন, আমিই আইন, ওরা নয়।

১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ৬ দফার কারণে বঙ্গবন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ৬ দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ’৬৫-এর যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেন, পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এ বিষয়টিও গভীরভাবে তার চিন্তার মধ্যে ছিল। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ দাবি করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার পর জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এ অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। সেই হিসাবে, এ অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।

আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ তাকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের জন্য পরামর্শ দেন এবং দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন।

বিচারপতি মোরশেদ একজন প্রগতিশীল ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি।

আতিক হেলাল : কবি, শিশুসাহিত্যিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম