অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) হলো মস্তিষ্কের বিকাশজনিত রোগগুলোর মধ্যে একটি গ্রুপের রোগ, যার কারণ অনেকাংশে অজানা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে পারদ বিষাক্ততা, ভ্যাকসিন, কিছু খাবার, প্রসবপূর্ব সংক্রমণ যেমন ভাইরাল সংক্রমণ, ভারী ধাতু, কীটনাশক এবং অবৈধ ওষুধের মতো পরিবেশগত বিষয়গুলোকে সম্ভাব্য কারণ হিসাবে দেখা হয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ প্রমাণগুলো যে তথ্য দেয় তা হলো-অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে পুষ্টি একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। নির্দিষ্ট মাতৃপুষ্টির ঘাটতি সন্তানদের একটি বাড়তি ঝুঁকিতে রাখে বলে মনে করা হয়। কারণ, ভিটামিন ডি, জিঙ্ক ইত্যাদির সঙ্গে মস্তিষ্কের বিকাশের বিষয়টি জড়িত। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এএসডির বিকাশ বা তীব্রতার সঙ্গে খাদ্য তালিকায় পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের (PUFA) কম ঘনত্বের সম্পর্ক রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মস্তিষ্কের বিকাশে পুষ্টির গুরুত্ব নিয়ে গবেষণাগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক স্নায়ু বিকাশ এবং কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির (অ্যামিনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন, ট্রেস উপাদান এবং খনিজ) গুরুত্ব প্রকাশ করেছে। পুষ্টি উপাদানগুলো বিল্ডিং ব্লক হিসাবেও কাজ করে, যা কোষের বিস্তার, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) সংশ্লেষণ এবং মস্তিষ্কে হরমোন/নিউরোট্রান্সমিটারের বিপাককে সহায়তা করে।
মস্তিষ্কের বিকাশ জটিল এবং এটি সাধারণত জরায়ুতে শুরু হয় প্রারম্ভিক প্রসবপূর্ব পর্যায়ে, নিউরনের বিস্তার এবং বিভিন্ন ধরনের নিউরোগ্লিয়া (যেমন রেডিয়াল গ্লিয়া) যা প্রায় তিন বছর বয়স পর্যন্ত প্রসব-পরবর্তী চলতে থাকে। নিউরাল প্লেটটি নিউরাল টিউব গঠনের জন্য ভেতরের দিকে ভাঁজ করতে শুরু করে (গর্ভধারণের ২২তম দিন থেকে) এবং এ টিউবটি অবশেষে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে বিকশিত হয়। শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় মস্তিষ্কের বিকাশ জীবনের প্রাথমিক বছরগুলোতে দ্রুত হয়। এটিকে খাদ্য তালিকাগত ঘাটতির জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফলিক অ্যাসিড, কপার ও ভিটামিন এ-এর পুষ্টির ঘাটতি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের বিকাশের প্রাথমিক সময়কালে ঘটে, যা নিউরাল প্লেট বা টিউব ত্রুটির কারণ হতে পারে।
অটিজম আছে এমন কিছু শিশু দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্য (ল্যাকটোজ বা কেসিন নামক প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত) এবং/অথবা গমের পণ্যের (গ্লুটেন) প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ প্রতিক্রিয়াগুলো অ্যালার্জি হতে পারে বা না-ও হতে পারে।
অনেক শিশুর মতো অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত সালাদ ও ফলের চেয়ে চিকেন নাগেট এবং পিৎজা পছন্দ করে বেশি। যে বাচ্চাদের অটিজম আছে, তারা খুব নির্দিষ্ট কিছু খাবার পছন্দে একেবারে আটকে যেতে পারে, এমনকি খাদ্যের সামান্য পরিবর্তন একেবারেই মেনে নিতে পারে না, যা সঠিক পুষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এএসডি শিশুরা পুষ্টির ঘাটতি পোষণ করে, যা স্বাভাবিক জনসংখ্যার মধ্যে কম দেখা যেতে পারে। এএসডি শিশুদের মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ এবং ই, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ডি এবং কার্নিটাইন, পটাসিয়াম, কোলিন ইত্যাদি অনেক কম পাওয়া গেছে।
অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সেরা ডায়েট : যদিও এমন একটি নির্দিষ্ট খাদ্য নেই, যা অটিস্টিক ব্যক্তিদের জন্য সুপারিশ করা হয়, তবে কিছু খাবার রয়েছে, যা অটিজমের লক্ষণগুলো কমাতে পারে এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। গ্লুটেনমুক্ত ও কেসিনমুক্ত ডায়েট (GFCF ডায়েট) সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সহনীয় হয়।
ASD-এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যোগাযোগ গম ও দুগ্ধজাত পণ্যের সঙ্গে। যাদের এএসডি থাকে, তারা এ ডায়েটে ভালো বোধ করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের খাদ্যে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড যোগ করলে তাদের উদ্বেগের মাত্রা কমে যায়। একটি মাল্টিভিটামিন সম্পূরক বা প্রোবায়োটিক প্রতিদিনের অন্তর্ভুক্তি হজমে এবং ঘুমাতে সাহায্য করতে পারে এবং পুষ্টির ঘাটতিতেও সাহায্য করতে পারে। চিনি ও পরিশোধিত চিনি এএসডিতে আক্রান্ত শিশুর রক্তে শর্করার মাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু খাবার এএসডির রোগীর জন্য ভালো, যেমন জিঙ্ক এবং ভিটামিন ডি, ফাইবার, যেমন-মটরশুঁটি, বাদাম, বিশেষ করে আখরোট, বীজ, যেমন চিয়া বীজ এবং শণের বীজ। ঘাসফেড গরুর মাংস বা পশু প্রোটিন। ফোর্টিফাইড (ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ভরা) ডিম। যে মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে, যেমন স্যামন, টুনা। বিকল্প দুধ, যেমন সয়া বা বাদাম, শাকসবজি, যেমন পালং শাক, শসা এবং তাজা ফল ইত্যাদি।
বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ফোলেট (ফলিক অ্যাসিড), ওমেগা-৩ এবং ভিটামিন ডি ৩-এর মতো সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করলে এবং ভিটামিনের ঘাটতি দূর করলে মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা অটিজমের ঝুঁকি কমায়।
ডা. সাইফুন নাহার : সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট; সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট