অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থারও গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাতে। এক্ষেত্রে একেবারে শুরু থেকেই শাসকশ্রেণি ব্যক্তি বা বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করেছে। সরকার কোনো আর্থিক দায়দায়িত্ব বহন করবে না; শিক্ষকদের সামান্য পরিমাণ বেতনভাতা এবং অন্যান্য যাবতীয় আর্থিক ব্যয়ভার প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে-আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার শুরুতে এ ছিল সরকারের নীতিমালা। ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পার করে এমনকি মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও আমরা পালন করেছি।
আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) সামান্য ভাতা প্রদানের মধ্য দিয়ে সরকারি অনুদানের শুরু হয়; তবে কখন থেকে তা সঠিকভাবে হয় জানা নেই। পাকিস্তানি জমানায় একজন বেসরকারি শিক্ষক সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক পাঁচ টাকা পেতেন। এটি ‘মাগগি-ভাতা’ বা মহার্ঘ-ভাতা নামে পরিচিত ছিল। এ পাঁচ টাকার বাইরে বেতনভাতা হিসাবে আর যা-ই কিছু দেওয়া হতো, সামর্থ্য অনুযায়ী সবই যার যার প্রতিষ্ঠান থেকে।
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার শাসনামলে ১৯৫৭ সালে দেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) ১ হাজার ৬০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আনুমানিক ২০ হাজার শিক্ষক তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট শুরু করেন। অন্যসবের মধ্যে শিক্ষকদের প্রধান দাবি ছিল মহার্ঘ ভাতা পাঁচ টাকা থেকে বাড়িয়ে বিশ টাকায় উন্নীত করতে হবে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি।
চার-পাঁচদিন ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, মেনে নাও’ এমনসব স্লোগান আর শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মাঠ থেকে শূন্য হাতেই শিক্ষকদের যার যার স্কুলে ফিরে যেতে হয়। পরের বছর ১৯৫৮ সালে একই দাবিতে শিক্ষকরা আবারও রাজপথে নামেন। এবার বিশ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষকের সঙ্গে সারা প্রদেশের ৬৪টি কলেজের মোট আনুমানিক ১ হাজার ১০০ অধ্যাপকও যোগ দেন। লাগাতার ধর্মঘটের ফলে স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে থাকে। এতে সরকারের বোধোদয় হয় এবং শিক্ষকদের আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে সরকার। প্রথমে দ্বিগুণ অর্থাৎ পাঁচ টাকার স্থলে দশ টাকা এবং পরে মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য মহার্ঘ ভাতা পনেরো টাকায় উন্নীত করা হয়। আর অধ্যাপকদের (বেসরকারি কলেজ শিক্ষক) জন্য মহার্ঘ ভাতা করা হয় মাসিক বিশ টাকা।
বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থার কথা মনোযোগ সহকারে কেউ কখনো শোনেনি। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দর মির্জার আমলেই প্রদেশব্যাপী আবারও শিক্ষক অসন্তোষ দেখা দেয়। এবার অধ্যাপকরা পঞ্চাশ টাকা এবং মাধ্যমিক শিক্ষকরা ত্রিশ টাকা করে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের দাবি জানান। ইতোমধ্যে রাজধানী করাচিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সামরিক আইন জারি এবং ইস্কান্দর মির্জাকে বিদায় করে তার স্থলাভিষিক্ত হন (২৭ অক্টোবর ১৯৫৮) জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।
আজকের দিনে কাউকে সহজে হয়তো বিশ্বাস করানো যাবে না; আর বিশ্বাস না করারই কথা যে, ষাটের দশকের শেষদিকে আইয়ুবের জমানায় বেসরকারি একজন কলেজ শিক্ষককে সরকারি কোষাগার থেকে অনুদান হিসাবে দেওয়া হতো মাসিক ত্রিশ টাকা আর বিশ টাকা করে পেতেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রতি তিন মাস অন্তর প্রতিষ্ঠানের নামে একসঙ্গে টাকাটা মানিঅর্ডারে এলে তারা তা হাতে পেতেন (অবশ্য চার-সাড়ে চার মাস আগে টাকা পাওয়াটা সম্ভব হতো না)। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য-কলেজের ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ শিক্ষক; পদ-পদবিতে যিনি যাই হোন না কেন, অনুদানের পরিমাণটি সবার জন্যই এক অর্থাৎ মাসিক ত্রিশ টাকা হারে নির্দিষ্ট ছিল।
১৯৭১ সালে অপরিমেয় ত্যাগ আর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত শিক্ষকদের ভাগ্যের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ এক কঠিন বাস্তবতা। একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের পথচলার শুরু। একদম কপর্দকহীন, চারদিকে স্বজনহারাদের আহাজারি; শুধু নেই আর নেই। তা সত্ত্বেও সরকার শিক্ষকদের অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী কলেজ শিক্ষকরা ৩০ টাকার স্থলে ৫০ টাকা আর স্কুল শিক্ষকরা ২০ টাকার স্থলে পান মাসিক ৩০ টাকা করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আর্থিক সুবিধাদিসহ পেশাগত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার থেকেছেন সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। তবে এক্ষেত্রে তাদের ভাগ্য তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সুপ্রসন্ন হয় সত্তরের দশকের শেষদিকে। এর ফলে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পর তাদের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসতে থাকে। ১৯৭৭ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যের এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। সে বছর শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধাদি বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।
কলেজের অধ্যাপকরা বর্তমানের ১০০ টাকার স্থলে ২০০ টাকা, ডেমোনস্ট্রেটররা ৭৫ টাকার স্থলে ১১০ টাকা; মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা (বিএডসহ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর) ৭৫ টাকার স্থলে ১১০ টাকা ও (স্নাতক) ৭৫ টাকার স্থলে ১০০ টাকা এবং মাদ্রাসার কামেলদের ৫৫ টাকার স্থলে ১০০ টাকা, বিএডসহ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ৬০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা, ফাজেলদের ৪৫ টাকার স্থলে ৬৫ টাকা এবং স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ৫০ টাকার স্থলে ৬৫ টাকায় উন্নীত করে ১ জুলাই ১৯৭৭ থেকে কার্যকর করা হয়। উল্লিখিত হারে শিক্ষকরা আড়াই বছর পর্যন্ত আর্থিক সুবিধাদি পেয়ে যান।
দিন গড়াতে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর দশ বছর যেতে না যেতে ১৯৮০ সালে যা ঘটল একে বেসরকারি শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে একটি বিপ্লব বলা যেতে পারে। এই প্রথম স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে স্কেলের পঞ্চাশ শতাংশ অর্থ সরকারি তহবিল থেকে দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। ডিগ্রি কলেজের যোগ্যতাসম্পন্ন একজন অধ্যক্ষ বিদ্যমান ২১০০ টাকার স্কেলের (১৯৭৭ সালে ঘোষিত) অর্ধেক ১০৫০ টাকা, উপাধ্যক্ষ ১৮৫০ টাকার স্কেলে ৯২৫ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ১৪০০ টাকার স্কেলে ৭০০ টাকা এবং প্রভাষক ৭৫০ টাকার স্কেল অনুযায়ী ৩৭৫ টাকা পান। মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেলায়ও যার যার স্কেল অনুযায়ী একই নিয়ম।
অন্যদিকে কলেজ শিক্ষকদের ‘অধ্যাপক’ পদবির বদলে তাদের শুরুতে সরকারি কলেজের মতোই ‘প্রভাষক’ ও সংখ্যানুপাতিক হারে কিংবা পরবর্তী সময়ে ‘সহকারী অধ্যাপক’ হিসাবে অভিহিত করা হয় (তবে চালুর পর চল্লিশ বছর গত হলেও সহকারী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতি পেয়ে তাদের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি)। আর্থিক সুবিধাদির ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেলায়ও বেতন স্কেল অনুযায়ী একই নীতি অনুসরণ করা হয়।
যার যার বেতন স্কেল অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষকদের (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) উল্লিখিত আর্থিক সুবিধাদি ১ জানুয়ারি ১৯৮০ থেকে কার্যকর হয়। পরবর্তীকালে সময় সময় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার করে আর্থিক সুবিধাদি বাড়ানো হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বেশিরভাগ দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যদশার চিত্রটি বেশ পুরোনো। তবে সময়ের ব্যবধান আর নানা পথ-পরিক্রমায় আগের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে সেই পাঁচ টাকা দিয়ে শুরু; এখন প্রতিষ্ঠান গৌণ, বেশিরভাগ আর্থিক সুযোগ-সুবিধাই আসে সরকারি কোষাগার থেকে। কলেজের একজন অধ্যক্ষ চতুর্থ গ্রেডে ৫০ হাজার ৫০০, উপাধ্যক্ষ পঞ্চম গ্রেডে ৪৩ হাজার, সহকারী অধ্যাপক ষষ্ঠ গ্রেডে ৩৫ হাজার ৫০০ এবং প্রভাষকরা নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকার স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন ও অন্য কিছু সুবিধা পাচ্ছেন। যার যার স্কেল অনুযায়ী এমপিওভুক্ত অন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও এমনই চিত্র। পরিমাণে যাই হোক, রয়েছে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার বন্দোবস্তও।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক