একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই
ড. এম এ মাননান
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সে সময়টার পুরোটাই ছিল সারা দেশে শকুনের আনাগোনা। শুরুটা হয়েছিল ২৫ মার্চের রাতে, চলেছে দীর্ঘ নয় মাস।
এ শকুনের দল পরিকল্পিতভাবে সারা বাংলায় গণহত্যা চালিয়েছে, নির্মমভাবে নিধন করেছে আবালবৃদ্ধশিশু ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, শহরের অলিগলি-গ্রামগঞ্জে। বাদ যায়নি পাহাড়ি এলাকা কিংবা জলাঞ্চল-চরাঞ্চল অথবা খেত-খামার, হাটবাজার। বর্বরতা চালিয়েছে নির্বিকার চিত্তে।
সব বাঙালির বুকের মধ্যখানে সুউচ্চ মর্যাদার আসনে বসা বাংলার অবিসংবাদিত নেতার আহ্বানে মানুষজন যখন মুক্তির চেতনায় জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার বুকে তাদের খঞ্জর নিয়ে। কখনো ভুলতে পারব না সেই দিনগুলোর কথা। ভোলা যায় না ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার নারকীয় স্মৃতি।
সেই কালরাতে ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ বাঙালির ওপর ট্যাংক, কামান নিয়ে হামলা করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, হানাদার সেনারা বাঙালিদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে মানুষদের হত্যা করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান আর নিয়াজীর নেতৃত্বে চলে বাংলার বুকে এ নির্বিচার গণহত্যা। তার সহযোগীরা ছিলেন উর্দিপরা প্রেসিডেন্ট রাজশাসক ইয়াহিয়া আর গণতন্ত্রের মূল শত্রু জুলফিকার আলী ভুট্টো। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে তারা ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ‘আনুমানিক ১১টার দিকে’ শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর। হায়েনারা অমানবিক আক্রমণ চালায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে। এ কারণেই রাতটির নাম হয়েছে ‘কালরাত’। এমন আচমকা আক্রমণ হয়েছিল যে, আমরা গগনবিদারী আর্তনাদ আর চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। সারা ঢাকা শহরে ছিল রক্তের বন্যা। সেনা ট্যাংক ঢাকার রাজপথে নেমে গুলিতে গুলিতে বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে চেয়েছিল প্রতিবাদী বাঙালির স্বাধীনচেতা মানসিকতাকে।
দীর্ঘ ২৩ বছরের অপশাসন আর বঞ্চনার কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, মূলত সেটিকে নৃশংসভাবে দমনের প্রচেষ্টারই একটা অংশ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা। এ গণহত্যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ভিয়েতনামে আমেরিকান বাহিনীর ইতিহাসখ্যাত গণহত্যা ‘মাইলাই’-এর কথা। একবার ভিয়েতনামে ভ্রমণ করতে গিয়ে শুনেছি-সেখানেও দখলদার বাহিনী শহরে, গ্রামে এবং অন্যান্য স্থানে যাকে যখন পেয়েছে, তাকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে। মাইলাইয়ের মতো গণহত্যা চালিয়েছে সমগ্র ভিয়েতনামে গুলি করে, বোমা ফেলে, আগুনে পুড়িয়ে। গণহত্যাগুলোয় সেখানেও অংশ নিয়েছিল ছিল একশ্রেণির দেশীয় কলাবোরেটর, যাকে আমরা বলি রাজাকার। বাংলাদেশেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একই কায়দায় ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার মাইলাই সৃষ্টি করেছিল।
গণহত্যা শুধু ২৫ মার্চ রাতেই সংঘটিত হয়নি। ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মা-বাবা-ভাইবোনদেরও রাজাকারদের সহায়তায় নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সারা দেশে। গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারে লাইন ধরিয়ে বাঙালিদের দলবদ্ধভাবে খুন করা হয় গুলি করে, গলা কেটে। শিশুদের প্রতিও তারা একটু দয়া করেনি। অগণিত শিশুকে আছাড় মেরে কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা নয় মাস ধরে সর্বত্র শুধু জ্বালাও-পোড়াও আর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ নানা মানবতাবিরোধী অপকর্ম চালিয়েছে, যা জানাজানি হওয়ার পর সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এরূপ পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতি হিসাবে বাঙালিদের পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং এ ভূখণ্ডে গোলামির রাজত্ব কায়েম করা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘১৯৭১-এর ২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানি জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠক করে এ গণহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়াহিয়া খানরা ভেবেছিল, এ রকম গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য পরাস্ত করা যাবে; কিন্তু পাকিস্তানিরা জানত না, যে জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে জাতি কখনো পরাজিত হতে পারে না; সেই জাতিকে ‘দাবায়ে’ রাখা অসম্ভব। তার মতো সব শাসকরাই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, কোনো শোষিত-বঞ্চিত জাতিকে বুলেট দিয়ে হয় তো সাময়িকভাবে দখল করা যায়; কিন্তু তাদের চিন্তাচেতনাকে কখনো দখল করা যায় না।
পাকিস্তানি শাসকদের একটি বড় মর্মজ্বালা ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও রূপকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতির হৃদয়জয় করা চৌকশ নেতৃত্ব। তাদের অস্থির করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে একাধারে চব্বিশ দিন ধরে চলা অসহযোগ আন্দোলন এবং ৬ দফার ব্যাপারে তার অনড় অবস্থান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশল তাদের কাছে ছিল একেবারেই অভাবনীয়। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পেরে, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অনেক কূটকৌশল চালিয়েও কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়ে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিশমায় সামরিক জান্তা ভীতবিহ্বল হয়ে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই তাকে তার বাড়ি থেকে বন্দি করে। ক্ষিপ্ত হয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ বহু মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়, নির্বিচারে চালায় গণহত্যা। সেই কালরাত্রিতে তারা হানা দেয় পূর্বপরিকল্পিত অনেক স্থানে; গণহত্যার উদ্দেশ্যে জিগাতলার সন্নিকটে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগে অবস্থিত পুলিশ লাইন্স, যেখানে থাকতেন মূলত বাঙালি পুলিশরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে বসবাস করতেন জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীরা; আর শাসকবিরোধী আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন।
সেই কালরাত্রিতে তারা আরও ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার, নয়াবাজার-বংশাল-ইংলিশ রোড এলাকায়, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে। যিনি ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির প্রথম থেকেই, সেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন-তাকে সামরিক জান্তা অ্যারেস্ট করবেই। তাই তিনি সময় থাকতেই ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়ে দেন আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে। বলেছিলেন-এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। সেই থেকে শুরু হলো আপামর জনতার লড়াই, একটি পরিপূর্ণ জনযুদ্ধ। নয়টি মাস ধরে বিপুল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এত হত্যার পরও অদম্য বাঙালি জাতিকে রুখতে পারেনি তারা; পারেনি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বুঝতেই পারেনি-নিজেদের অজান্তেই গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা তাদের শাসনব্যবস্থার দেহে অন্তিম পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে এবং কফিন দিয়ে সাজিয়েছে পাকিস্তানের অন্তিম শয্যা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি-স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই একাত্তরের শকুনিদের দোসররা একাধিকবার গণহত্যা চালিয়েছে। একবার ১৫ আগস্টে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে, যেদিন রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতার পরিবারের সব উপস্থিত সদস্যকে; আরেকবার ২১ আগস্টে, যেদিন আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা করা হয় বিনা অপরাধে, আহত করা হয় বহু নাগরিককে। এ ধরনের শকুনিদের উৎপাত চিরকালের জন্য স্তব্ধ করার জন্যই প্রয়োজন যে কোনো ধরনের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার হওয়া এবং পরিকল্পিত সামাজিক আন্দোলন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে গণহত্যা চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যেই প্রয়োজন ১৯৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একই সঙ্গে সে সময়ের গণহত্যার মর্মন্তুদ দিকগুলো এখনকার এবং আগামী প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন, যাতে নবীন প্রজন্ম বুঝতে পারে কত ত্যাগের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার জন্য কত রক্ত কত রকমভাবে এ দেশের মাটিতে ঝরেছে, কত পরিবার সর্বহারা হয়েছে এবং হারিয়েছে সবকিছু।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে এবং পরবর্তী সময়ে সারা বাংলায় সংঘটিত গণহত্যার বিচার, ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন এবং গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি ছিল বহুদিনের। তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে গণহত্যা দিবসের দাবি তোলেন। তার এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরই প্রথমবার গণহত্যা দিবস পালন করা হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে নানামাত্রিক আনুষ্ঠানিকতায়, শোকের পোশাকে জড়িয়ে। গণহত্যার স্মৃতিকে স্মরণে অম্লান রেখে নতুন করে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে-এদেশে যেন পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসররা কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কখনো শক্তি খুঁজে না পায়, গণহত্যার শিকার শহিদদের বিদেহী আত্মার বুকের ওপর দিয়ে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রীয় গাড়িতে বাংলাদেশের পবিত্র পতাকা ঝুলিয়ে আর কখনো আস্ফালন করে ঘুরে বেড়াতে না পারে। পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে, সাম্প্রদায়িকতাকে উপড়ে ফেলে দিতে, মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যায় লিপ্ত রাজাকার ও তাদের দোসরদের অস্তিত্ব মুছে দিতে, এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে।
ড. এমএ মাননান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য