Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমলাতন্ত্রে মেধা ও সততার সমন্বয় প্রয়োজন

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমলাতন্ত্রে মেধা ও সততার সমন্বয় প্রয়োজন

একটি সরকারের হৃৎপিণ্ডে আমলাতন্ত্রের অবস্থান। আমলাতন্ত্রকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের চালিকাশক্তিও বলা যেতে পারে।

এ কারণে একটি দেশের সরকারযন্ত্র কেমন চলছে বা কেমন চলবে তা বোঝা যায় সেদেশের আমলাতন্ত্রে অবস্থান করা আমলারা কতটা মেধাবী আর চৌকশ তার ওপর। আমলাতন্ত্রের সততা, দৃঢ়তা ও জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি একটি দেশকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখে।

পাকিস্তান আমলে দেখেছি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পরিচালনায় সিএসপি অফিসার আর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইপিসিএস অফিসারদের উপস্থিতি।

উভয় অফিসাররা কঠিন পরীক্ষার বৈতরণি পাড়ি দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে নিয়োগ পেতেন। আমলাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতার কারণে যোগ্য প্রশাসন গড়ে উঠত। বাংলাদেশ আমলে সরকার পরিচালনার হৃৎপিণ্ড হিসাবে ইপিসিএস ও সিএসপি অফিসারদের জায়গায় এলেন বিসিএস অফিসাররা। নানা ক্যাডারে নিযুক্ত হন তারা। এখানে আবার ক্যাডারবিশেষে অতি অভিজাত, অভিজাত এবং কম অভিজাত ইত্যাদি মানসিকভাবে বিভাজিত ক্যাডার রয়েছে। এদের মধ্যে আবার কোনো ক্যাডার অতি সুবিধাভোগী আবার কোনো কোনো ক্যাডার কম সুবিধাভোগী হিসাবে নিজেদের মনোজগতে সীমারেখা টেনে রেখেছেন। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী অনেকেই নানা ধারার আমলা ছিলেন এবং আছেন। তাদের কিছুটা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। তাদের অধিকাংশই মেধাবী। আবার উচ্চাসনে বসা কারও কারও ভূমিকা ও ক্ষমতা প্রয়োগের নমুনা দেখে কখনো কখনো হতাশ হয়েছি। তখন সত্যিই মনে হয়েছে, আমলাতন্ত্রে মেধা ও সততার সমন্বয় খুব প্রয়োজন।

আরেকটি বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। যেহেতু এদেশের সমাজে এখন সম্মানজনক চাকরি বলতে অনেকেই বিসিএস অফিসার হওয়াকেই বোঝেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বিসিএসের প্রস্তুতিতে নেমে যায় বড়সংখ্যক তরুণ-তরুণী। আজকাল অভিভাবকদের অনেকেই সন্তান কতটা জ্ঞানচর্চা করল সেদিকে না তাকিয়ে স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় এ প্লাস পেল কিনা তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন; তেমনি শিক্ষাজীবনে জ্ঞান কতটা অর্জন করল তার বদলে কোন সরল পথ ধরে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অভিজাত চাকরি পাওয়া যায় তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশ সেদিকেই ঝুঁকছে। এ কারণে এখন নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে ভোর থেকেই লেগে যায় বিসিএস পরীক্ষার্থীদের লাইন। ওরা বিশ্বাস করে, দু-তিন মাস কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স টাইপের বইপত্র মুখস্থ করতে পারলে ‘স্বর্গ’ দুয়ারের চাবি পাওয়া যাবে। তাই আমার আশঙ্কা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বর্তমান ধারায় এ প্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের জ্ঞান যেমন একটি গণ্ডিতে আটকে থাকতে দেখি, তিন মাস ঠোঁটস্থ করে দেদার বিসিএস অফিসার হতে দেখলে তেমনি কিছুটা শঙ্কা হয় বৈকি।

এসব কারণে কিনা জানি না কোনো কোনো প্রশাসনের বড় কর্মকর্তার আচরণ পত্রিকার শিরোনাম হয়; তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। বিশেষ করে শিক্ষক হিসাবে লজ্জাটা কোনো না কোনোভাবে নিজের ঘাড়েও পড়ে। যেমন করোনাকালে পত্রিকায় দেখেছিলাম সম্ভবত একজন ইউএনও ম্যাডাম তাকে ঠিকমতো সম্মান না দেওয়ায় প্রকাশ্যে গরিব মাছ বিক্রেতাকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ স্যার না বলায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হালে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাণ্ড ভাইরাল হয়েছে। স্কুলে তার সন্তানের সঙ্গে সহপাঠীদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা। এরপর হুলুস্থুল কাণ্ড। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক খবরের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তাই অমন সংবাদ পড়ে হুবহু সত্য বলে মানতে মন সায় দেয়নি। কিন্তু এরপরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিওচিত্র দেখলাম। জেলা প্রশাসক মহোদয় দুই পক্ষকে ডেকে বৈঠক আয়োজন করেছিলেন। ডিসি মহোদয় খুব দক্ষতার সঙ্গে সভাটি পরিচালনা করলেন। তাতে প্রকাশিত সত্য জেনে লজ্জিত হতে হলো।

এ ঘটনার রেশ না কাটতেই রংপুরের ডিসি মহোদয়া মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেননি বলে। প্রজাতন্ত্রের কোনো কোনো সেবক হঠাৎ এত সম্মানের কাঙাল হয়ে গেলেন কেন বুঝতে পারলাম না। ভেবে অবাক হলাম, ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তা হয়েও কেউ কেউ জানেন না, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলায় বাধ্যবাধকতা দিয়ে অদ্যাবধি কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। অবশ্য ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে ডিসি মহোদয়া ‘সমঝোতা’ করে দ্রুতই এ অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনেছেন।

২০১৮তে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কুইন্স ইউনিভার্সিটি, বেলফাস্টে আমার স্নেহভাজন বাংলাদেশের এক দম্পতি থাকে। মেয়েটি প্রাইমারি শিক্ষার ওপর গবেষণা করে এখন শিক্ষকতা করছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল ভালো স্টাইপেন্ড নিয়ে বাংলাদেশ থেকে মাঝেমধ্যে সরকারি আমলারা আসেন ডিপ্লোমা ও গবেষণা করতে। এখানকার শিক্ষকরা প্রশ্ন করেন, এসব গবেষণায় বিভিন্ন দেশ থেকে যেখানে শিক্ষকরা আসেন, আমাদের দেশ থেকে কেন আসেন আমলারা! তারা ফিরে গিয়ে কী অবদান রাখবেন? এদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব বিভিন্ন টিভি টকশোতে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কথা বলেন। প্রায়ই বলেন, পৃথিবীর ৪১টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনা নিজে পর্যবেক্ষণ করেছেন। মনে মনে ভাবি, যেখানে সরকারি অর্থে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত হওয়ার জন্য যাওয়ার কথা, সেখানেই হয়তো অন্য কেউ বারবার ভাগ বসিয়েছেন।

আমলাদের নৈতিকতায় ভাঙন ধরাতে রাজনৈতিক সরকারগুলো কম ভূমিকা রাখেনি। এ বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট যে, রাজনৈতিক সরকারগুলো নির্বাচনে আমলাদের ব্যবহার করতে গিয়ে এদের নৈতিকমান অনেকটা নামিয়ে ফেলেছে।

অতিসম্প্রতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র শিক্ষক আমলাতন্ত্রের কাজের নমুনা নিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন নতুন প্রয়োজনীয় বিভাগ খোলা হচ্ছে। কলেজগুলোয় সরাসরি সেই নামের বিভাগ নেই। তাই শিক্ষা ক্যাডারে পঠিত সিলেবাস দেখে প্রচলিত যে বিভাগের সঙ্গে ম্যাচ করে এমন সব বিভাগে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

আমাদের দেশের জন্য তেমন একটি বিভাগ প্রত্নতত্ত্ব। এ বিভাগের সিলেবাসের সঙ্গে ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সিলেবাসের অনেক বেশি মিল রয়েছে। এর বাইরেও প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থীরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনেক ব্যাবহারিক বিষয়ও পড়ে থাকে। বিশেষ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস চর্চা এখানে অনেক বেশি গভীরভাবে করা হয়। তাই প্রত্নতত্ত্বে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর শিক্ষা ক্যাডারে ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অনেক ভালোভাবে শিক্ষকতা করার সক্ষমতা থাকার কথা।

এ বিষয়ে ইউজিসির পরামর্শে শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সমুদয় সিলেবাসসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আবেদন করে। এ ফাইল ঘুরতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রায় এক বছর লেগে যায়। অবশেষে ইতিবাচক পরামর্শ দিয়ে ফাইল পাঠানো হয় ইউজিসিতে। ইউজিসি বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসসহ কাগজপত্র পাঠায়। বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তুল্যমূল্য বিচার করে জানান, প্রত্নতত্ত্বে স্নাতকোত্তর করা শিক্ষার্থী ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য। ইউজিসি বিশেষজ্ঞ মতামতসহ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ধীরগতিতে চলাফেরার কারণে আরও প্রায় এক বছর লেগে যায়। এরপরে চূড়ান্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সবকিছু পরীক্ষা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারি কর্ম কমিশনে ফাইলপত্র পাঠায়।

এবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত হয় ক্যাডারভুক্ত হবে বলে। এখানে যেহেতু কোনো পদ সৃষ্টির বিষয় নয়, শুধু ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসে আবেদন করার যোগ্যতায় প্রত্নতত্ত্বের ডিগ্রিধারীরা যোগ্য বিবেচিত হবে। এটুকু লিখতে কয়েক মাস কেটে গেল। কিন্তু এখানে সহজে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সুযোগ থাকলেও কর্ম কমিশন ফেলে রাখল। লালফিতার দৌরাত্ম্যে আটকে গেল। অবশেষে কর্ম কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন একজন অধ্যাপক।

সব কাজপত্র থাকার পরও তারা কী লিখবেন তা নিশ্চিত হতে পারছেন না। অবশেষে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য আবার চিঠি পাঠানো হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে চিঠির কপি দিয়েও অবগত করা হয়। সঙ্গে রয়েছে পূর্বাপর সব ফাইলের সূত্র। কিন্তু আর কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। অবশেষে জনপ্রশাসনে কাজ করা একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অধ্যাপক মহোদয় খোঁজ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এ সাবেক কর্মকর্তা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন। এখানকার মাঝারি গোছের আমলার টেবিলে চিঠিটি রয়েছে। এই যে দুই বছর ধরে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে ফাইল কর্ম কমিশন পর্যন্ত গেল, এর কিছুই তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। তিনি খোঁজ নেওয়া সাবেক কর্মকর্তাকে জানালেন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তো কলেজে নেই, সুপারিশ করব কীভাবে?

দুই বছর আগের কথা তিনি বললেন যেন! এ মেধাবী অফিসার চিঠিতে সূত্র উল্লেখ থাকার পরও বুঝতেই পারলেন না দুই মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি দীর্ঘ নিরীক্ষার পরই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। নাকি আমলাতন্ত্রে কোনো কিছুর সহজ সমাধানের প্রশিক্ষণ নেই। কারও ব্যক্তিগত লাভালাভ নয়-শিক্ষার্থীদের কল্যাণ চিন্তায় এমনিতেই তো মানবিক হওয়া উচিত ছিল।

এসব কাণ্ড দেখে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হতাশ। দুঃখ করে বলছিলেন, কোনো বিষয়ে গুরুত্ব অনুভব করার ক্ষমতা কি আমলাতন্ত্র থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে! এসব কাণ্ডে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এখন তারা দুটো বিকল্প ভাবছে। এক. সংবাদ সম্মেলন করে এ দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাতির সামনে তুলে ধরা অথবা প্রতিকারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। এর কোনোটিই আমলাতন্ত্রের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে হয় না।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম